২। মুহতাসিব আলাইহি - যার প্রতি আদেশ/নিষেধ করা হয়
কাদেরকে অসৎ বা মুনকার কর্মকান্ড হতে নিষেধ করা হবে সেটার লিস্ট দেখার আগে জানা উচিত এই হিসবা (আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার)-এর উদ্দেশ্যটা কী। ইমাম গাযালী তার ইহইয়া’তে বলেন,
হিসবা হলো আল্লাহর ওয়াস্তে কাউকে মন্দ কাজ হতে বিরত রেখে গুনাহ হতে রক্ষা করা।
অর্থাৎ এখানে উদ্দেশ্য দুটো,
(এক) আল্লাহর হক রক্ষা করা। অর্থাৎ, তাঁর বন্দেগীর বিপরীত হয় বা আল্লাহর দেয়া ইউনিভার্সাল মুল্যবোধ নষ্ট হয় এমন কাজ প্রতিরোধ করা।
(দুই) মাখলুকের হক রক্ষা করা। অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টির ক্ষতি বা অধিকার নষ্ট হওয়া প্রতিরোধ করা।
এই দুটো উদ্দেশ্যের যেকোনো একটি উপস্থিত হলেই হিসবা করা জরুরি হয়ে পড়ে। এর ভিত্তিতে বলা যায় মুহতাসিব আলাইহির ক্যাটাগরির মধ্যে পড়েঃ
প্রাপ্তবয়স্ক ও শরিয়তের মুকাল্লাফ পুরুষ ও নারী
অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোন ছেলে বা মেয়ে
শরিয়তের মুকাল্লাফ নয় এমন ব্যক্তি যেমন মানসিক বিকারগ্রস্থ বা পাগল বা ঘুমন্ত কেউ
ইমাম গাযালী আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, আদেশ/নিষেধপ্রাপ্ত হবার জোনয়ে শরিয়তের মুকাল্লাফ হওয়া জরুরি নয়। কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুকে যদি মদ্যপান করতে দেখা যায় তখন সেটা থামাতে হবে। এমনকি কোন পাগলকে যেনা/ব্যাভিচার করতে দেখলে সেটাও থামাতে হবে। কারণ তারা শরিয়তের মুকাল্লাফ হয়ে পাপী না হলেও এসবের ফলে আল্লাহ প্রদত্ত বিশ্বজনীন মুল্যবোধ নষ্ট হচ্ছে।
এখানে ইমাম গাযালী পশু-প্রাণীদের আলোচনাও এনেছেন। যদি কোন পশুকে কারও সম্পত্তি নষ্ট করতে দেখা যায় তাহলে তাকে থামানো হবে কিসের ভিত্তিতে? তিনি বলেন, এখানে তাকে থামানো হবে একজন মানুষের সম্পদ রক্ষার উদ্দেশ্যে, পশুর পাপ হবার বিষয় এখানে আসছে না।
প্রাপ্তবয়স্ক ও শরিয়তের মুকাল্লাফ পুরুষ ও নারী - এই ক্যাটাগরির মধ্যে নিজের দায়িত্ত্ব-অধিকারে আছে (যেমন স্ত্রী-সন্তান) এমন মানুষ যেমন পড়ে তেমনি পড়ে নিজের পিতা-মাতা, শিক্ষক, এমনকি শাসকও। তবে প্রত্যেকের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে আদেশ/নিষেধের পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন হবে। এটা পরের পরিচ্ছেদে আলোচনা করছি।
৩। আদেশ/নিষেধ করার পদ্ধতি
“তোমাদের কেউ যদি কোনো খারাপ কাজ বা বিষয় দেখে, তাহলে সে যেন হাত দিয়ে তা পরিবর্তন করে দেয়, যদি তা করতে অপারগ হয় তাহলে যেন মুখ দিয়ে তার প্রতিবাদ করে, যদি তাও করতে সক্ষম না হয় তাহলে যেন অন্তর দিয়ে তা ঘৃণা করে, আর এটিই হচ্ছে ঈমানের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বলতম স্তর।” ~ রাসুলুল্লাহ ﷺ
নাহি আনিল মুনকার বা মন্দ কাজ নিষেধের পদ্ধতির দশটি স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন ইমাম গাযালী তার ইহইয়া কিতাবেঃ
মন্দ কর্ম সম্পর্কে জানা ও অন্তরে ঘৃণা করা
এরপর তাকে সুন্দর ও উত্তম ভাষায় দরদের সাথে কাজটির মন্দ সম্পর্কে জানানো
তাতেও কাজ না হলে খানিক শক্তভাবে নিষেধ করা
এরপর কঠিনভাবে সতর্ক করা ও উপদেশ দেয়া
তারপর অপমান ও তিরস্কার করা
কাজ না হলে হাত দিয়ে থামানো বা জোরপূর্বক বিরত রাখা
এরপর প্রহার বা মারধর করার হুমকি দেয়া
তারপর সত্যিই তাকে প্রহার করা (এটা সম্পর্কের ভিত্তিতে হবে। নিজের অধিকারে হলে প্রহার করা যাবে নইলে শাসকের অনুমতি লাগবে)
এরপরেও কাজ না হলে শাসকের অনুমতি সাপেক্ষে অস্ত্র ব্যবহার করা
সবশেষে শাসকের সেনা মোতায়ন করা।
এখানে লক্ষ্য করুন, এক থেকে দশ পর্যন্ত যতো উপরের পর্যায়ে যাবে, সমাজে মুহতাসিবের সংখ্যা কমে আসবে। যেমন, প্রথম পর্যায়ে মন্দ কাজ সম্পর্কে জানা ও সেটাকে অন্তরে ঘৃণা করা প্রত্যেক মুসলিমেরই কর্তব্য। কিন্তু কঠিনভাবে সতর্ক করার দায়িত্ব সবার উপর বর্তায় না। এ ধরণের মানুষের সংখ্যা কম। আর অস্ত্র ব্যবহার করে নাহি আনিল মুনকার প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আরও কম মানুষের উপরেই থাকে। অতএব, আপনি সামাজিকভাবে এই দশ স্তরের কোন পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন সেটা চিন্তা করে দেখুন। সম্পর্ক ভেদে আপনার দায়িত্বের পরিধিতেও পরিবর্তন আসতে পারে।
৪। কি বিষয় আদেশ বা নিষেধ করা যাবে? (মুহতাসিব ফিহী)
একজনের দৃষ্টিতে কিছু মন্দ মনে হলেই সেটা থামাতে দৌড় দিলে চলবে না। কি বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ করা যাবে সেসবেরও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ইমাম গাযালি। সেটার সংক্ষিপ্ত পয়েন্টস উল্লেখ করে দিচ্ছি—
১. কর্মটি স্পষ্টভাবে শরিয়তের দৃষ্টিতে মুনকার হতে হবে—সেগুলো শাস্তির আবশ্যক করে এমন গুনাহই (যেমনঃ যেনা) হতে এমন এমনটা নয়। কারণ কিছু কাজ পাপ না হলেও আল্লাহর দৃষ্টিতে মন্দ (যেমন: পাগলের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ), তাই সেগুলোকেও প্রতিহত করতে হবে।
২. কাজটি তখনই ঘটতে থাকতে হবে—অতীতের কোনো কাজ বা ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন সন্দেহজনক কোনো কাজ নিয়ে জোর করে কিছু করা যাবে না। ভবিষ্যতের আশঙ্কা থাকলে শুধু উপদেশ বা সতর্ক করা যাবে, বলপ্রয়োগ নয়।
৩. কাজটি প্রকাশ্যে ঘটতে হবে—গোপনে বা ব্যক্তিগত জায়গায় ঘটে এমন কোনো মন্দ কাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করা যাবে না। ইসলামে গুপ্তচরবৃত্তি নিষিদ্ধ।
৪. কাজটি নিঃসন্দেহে মুনকার হতে হবে এবং তাতে ইজমা থাকতে হবে—যুক্তি বা ইজতিহাদের ভিত্তিতে মুনকার হওয়া যাবে না। যেমন: বিভিন্ন ফিকহী মতপার্থক্যের কারণে যেসব বিষয়ে মতভেদ রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে আদেশ/নিষেধ বা হিসবা করা যাবে না।
সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ যে ন্যায্য, প্রজ্ঞাপূর্ণ ও ইসলামী ন্যায়বিচারের সীমার মধ্যে থেকেই প্রয়োগ করা হচ্ছে তা নীচের চারটি পয়েন্ট এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়—
ভুলভাবে কাউকে অপরাধী না করা,
মাজহাবভিত্তিক মতবিরোধে জড়িয়ে না পড়া,
মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে অনধিকার হস্তক্ষেপ না করা,
অজ্ঞতা বা মতভেদজনিত ভুলের কারণে অপ্রয়োজনীয় শাস্তি না দেওয়া।
প্রথম পর্বের লিংকঃ https://sahilridwan.substack.com/p/1c7
দ্বিতীয় পর্বের লিংকঃ https://sahilridwan.substack.com/p/ae4