কুরআন হতে আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার
সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ আরবিতে ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ বলা হয়। দ্বীনের প্রধান একটি রুকন হলো এটি। সমস্ত নবীদের মুলত এই কাজ করতেই আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। সে হিসেবে প্রধান সৎ কাজের আদেশ হলো তাওহীদ অবলম্বন করা। আর প্রধান অসৎ কাজের নিষেধ হলো শিরক বর্জন করা। নবীজি মুহাম্মদ ﷺ-এর পর যেহেতু আর কোন নবী আসবেন না, তাই এই মহান দায়িত্ব এখন উম্মতের ঘাড়ে এসেছে। এই দায়িত্ব প্রধানত হলো উম্মতের আলেম ও উলুল আমর (শাসক) এর, এরপর প্রত্যেক মুসলিমের।
কিছু আয়াত দেখি চলুন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ ۚ وَأُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
অর্থাৎ, “তোমাদের মধ্যে এমন এক দল থাকতে হবে যারা দাওয়াত দেবে কল্যাণের প্রতি, সৎ কাজের নির্দেশ দেবে ও মন্দ কাজ হতে নিষেধ করবে। আর তারাই হবে সফলকাম।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১০৪)
এখানে আয়াতটি থেকে কয়েকটি বিষয় প্রমাণ করা যায়ঃ
· وَلْتَكُن দ্বারা প্রমাণিত হয় এই কাজটি বাধ্যতামূলক অর্থাৎ ফরজ।
· مِّنكُمْ أُمَّةٌ দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে এটা ফরজে কেফায়া। সবাইকে করা বাধ্যতামূলক নয়। তবে কেউই যদি না করে সকলকেই শাস্তি ভোগ করতে হবে।
· يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ দ্বারা উত্তম আখলাক দ্বারা দাওয়াত দেয়া প্রমাণ হয়।
· وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ দ্বারা সৎ ও ন্যায়ের প্রতি আদেশ দেয়া প্রমাণিত হয়।
· وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ দ্বারা অন্যায় ও অসৎ কাজের নিষেধ দেয়া প্রমাণিত হয়।
· أُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ অর্থ হলো এই কাজ যারা করবে তারাই হবে মুফলিহুন অর্থাৎ সফলকাম। সফলকাম অর্থাৎ আখিরাতে তারা জান্নাতের অধিবাসী হতে পারবে।
দ্বিতীয় আরেকটি আয়াত থেকে দেখতে পাবো ঈমানদার হবার শর্তের মাঝে আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহিল আনিল মুনকার অন্তর্ভুক্ত। যাদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য নেই তারা মুমিনদের তালিকা থেকে বাদ পড়বে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنٰتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ
অর্থাৎ, “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে।” (সূরা তাওবা, আয়াত ৭১)
এই সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ করার বৈশিষ্ট্যের জন্যেই আল্লাহ আমাদের এই উম্মতকে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত বলেছেন। তিনি বলেন,
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللّٰهِ
অর্থাৎ, “তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করবে।” (সূরা আলে ইমরান, ১১০)
চিন্তা করে দেখুন! আল্লাহ্র প্রতি ঈমানের সাথে “সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ”কে যুক্ত করা হয়েছে! কি পরিমাণ নববি দায়িত্ব এই উম্মতের কাঁধে! আল্লাহু আকবার!
আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার না করার পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ কুরআনে কিছু কথা বলেছেন।
فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِۦٓ أَنجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوٓءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍۭ بَـِٔيسٍۭ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ
[ভাবানুবাদ] “তারা যখন তাদেরকে দেয়া উপদেশ ভুলে গেলো তখন আমি শুধুমাত্র মন্দ কাজে নিষেধকারীদের উদ্ধার করলাম। আর জালিমদের তাদের ফাসেকী কর্মকান্ডের কারণে কঠোর শাস্তি দিলাম।” (সূরা ‘আরাফ, আয়াত ১৬৫)
অর্থাৎ আল্লাহ শুধুমাত্র মন্দকাজ থেকে নিষেধ করার কর্তব্য পালন করার কারণে কিছু মানুষদের রক্ষা করলেন। আর বাকিদের প্রচণ্ড শাস্তি দিলেন। এরকম বক্তব্য সূরা হুদের ১১৬ নম্বর আয়াতেও পাই যেখানে আল্লাহ বলছেন যে পূর্ববর্তী প্রজন্মের মধ্যেও অসৎকাজ থেকে নিষেধকারীদের সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় পুরো জাতি তিনি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। যদিও হাতেগোনা নিষেধকারীদের রক্ষা করেছেন। এরই পরের আয়াতে তিনি বলে দিচ্ছেন, “আর তোমার রব এমন নন যে, তিনি অন্যায়ভাবে জনপদসমূহ ধ্বংস করে দেবেন, অথচ তার অধিবাসীরা সংশোধনকারী।” অর্থাৎ, জনপদের মধ্যে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার চালু থাকলে তিনি তা এমনি এমনি ধ্বংস করে দেবেন না। নতুবা তা ধ্বংস করার থেকে তাঁকে আটকানোর কে আছে? কেউ নেই। এ প্রসঙ্গে আরও বহু বহু আয়াত আছে। কলেবর বৃদ্ধি হয়ে যাবে বলে আর উল্লেখ করলাম না।
আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার সম্পর্কিত কিছু হাদিস
সায়্যিদুনা আবু বকর (রাঃ) জীবনে খুব কম হাদিসই বর্ণনা করেছেন। সেই স্বল্প কিছু হাদিসের মধ্যে একটি হলোঃ আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, “যে সম্প্রদায় গোনাহ্ করে এবং তাদের মধ্যে এমন লোকও থাকে, যে তাদেরকে নিষেধ করতে সক্ষম, যদি সে নিষেধ না করে, তবে অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ্ তা'আলা তাদের সকলের প্রতি আযাব প্রেরণ করবেন।”[1]
বর্তমানে আমাদের সমাজে সৎ কাজের ব্যাপারে আদেশ আর মন্দ কাজের ব্যাপারে নির্ভয়ে নিষেধ করার এই বৈশিষ্ট্য বিলুপ্তপ্রায়। শুধুমাত্র সেসব পলিটিক্যালি কারেক্ট কথাই বলা হয় যেগুলো বললে প্রশাসন ও ফাসেক মানুষদের রোষানলে পড়তে হবে না। সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি আমল আর মিষ্টি মন্দ কাজের ব্যাপারে হাল্কা ওয়াজ নসিহত করে দায়িত্ব পালন হয়ে গেছে বলে মনে হয়। সৎ সাহসীরা কমতে কমতে এখন এমন অবস্থা এসে দাঁড়িয়েছে যে ভালো কাজ প্রকাশ্যে করাটাই লজ্জাজনক বিষয় হয়ে গেছে। আর যতো প্রকার দুর্নীতি, ফাসেকী আর ফাহেশাত প্রকাশ্যে করা হচ্ছে বুক উঁচিয়ে। কেউ যদি মিনমিন করেও সেসবের বিরুদ্ধে বলতে চায় তবে তার উপর নেমে আসে অত্যাচার, অবিচারের কষাঘাত। “তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। নতুবা আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ভালোদের উপর দুষ্ট লোকদেরকে চাপিয়ে দেবেন। তখন তোমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তি দোয়া করলেও তা কবুল হবে না।”[2] রাসুলুল্লাহর ﷺ এ কথা এখন অক্ষরে অক্ষরে ফলিত হচ্ছে।
আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার বিষয়ক সবচাইতে প্রসিদ্ধ হাদীস হচ্ছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“তোমাদের কেউ যদি কোনো খারাপ কাজ বা বিষয় দেখে, তাহলে সে যেন হাত দিয়ে তা পরিবর্তন করে দেয়, যদি তা করতে অপারগ হয় তাহলে যেন মুখ দিয়ে তার প্রতিবাদ করে, যদি তাও করতে সক্ষম না হয় তাহলে যেন অন্তর দিয়ে তা ঘৃণা করে, আর এটিই হচ্ছে ঈমানের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বলতম স্তর।”[3]
হযরত আবু হোরায়রার রেওয়ায়েতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ˹অনিচ্ছাকৃতভাবে বা কোন প্রয়োজনে˺ কোন গোনাহের স্থানে উপস্থিত থাকে এবং ˹অন্তর দিয়ে˺ তাকে খারাপ মনে করে, সে এমন যেন সেখানে উপস্থিত নেই। পক্ষান্তরে যে গোনাহের স্থানে উপস্থিত থাকে না, কিন্তু তাকে ভাল মনে করে, সে এমন যেন তাতে উপস্থিত রয়েছে।”[4]
ধাপে ধাপে যে অসৎ কাজের নিষেধ সমাজ থেকে উঠে যাবে সেই ভবিষ্যৎবাণী করে নবীজি থেকে একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে, আবু উমামা বাহেলীর রেওয়ায়েতে নবী করীম (সাঃ) বলেন: “তোমাদের কি অবস্থা হবে যখন তোমাদের স্ত্রীরা অবাধ্য হয়ে যাবে, যুবকরা কুকর্ম শুরু করবে এবং তোমরা জেহাদ পরিত্যাগ করবে?”
সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন: ইয়া রসূলাল্লাহ, এটা কি অবশ্যই হবে?
তিনি বললেন: যে আল্লাহর কব্জায় আমার প্রাণ, তার কসম, এর চেয়েও গুরুতর ব্যাপার হবে।
প্রশ্ন করা হল: এর চেয়ে গুরুতর ব্যাপার কি?
তিনি বললেন: তোমাদের কি দশা হবে যখন তোমরা ভাল কাজের আদেশ করবে না এবং খারাপ কাজ করতে নিষেধ করবে না?
প্রশ্ন করা হল: এটা কি হবে?
তিনি বললেন: হাঁ, আল্লাহর কসম, এর চেয়েও গুরুতর কাজ হবে।
শ্রোতারা আরজ করল: এর চেয়ে গুরুতর কাজ কি?
তিনি বললেন: তোমাদের কি অবস্থা হবে যখন তোমরা ভাল কাজকে মন্দ এবং মন্দ কাজকে ভাল মনে করবে?
তারা আরজ করল: ইয়া রসূলাল্লাহ্! এটাও হবে?
তিনি বললেন: যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম, এর চেয়েও কঠিন ব্যাপার হবে।
প্রশ্ন হল: এর চেয়ে কঠিন ব্যাপার কি?
তিনি বললেন: তোমাদের কি অবস্থা হবে যখন তোমরা অসৎ কাজের আদেশ করবে এবং সৎকাজ করতে নিষেধ করবে?
শ্রোতারা আরজ করল: এরূপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?
তিনি বললেন: হাঁ, আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, এর চেয়েও গুরুতর ব্যাপার হবে। আল্লাহ তা'আলা নিজের কসম খেয়ে বলেন, “আমি তাদের উপর এমন ফেতনা বসিয়ে দেব যে, তাদের বুদ্ধিমানরা পর্যন্ত ফেতানায় হতভম্ব হয়ে বিপাকে পড়ে যাবে!”[5]
ইকরিমা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়, তার কাছে দাঁড়িয়ো না। কেননা, যে সেখানে উপস্থিত থাকে এবং এই বিপদ প্রতিরোধে সচেষ্ট হয় না, তার উপর অভিসম্পাত বর্ষিত হয়। যাকে অন্যায়ভাবে প্রহার করা হয়, তার কাছেও দাঁড়িয়ো না। কেননা, যে তার কাছে থেকে যুলুম প্রতিরোধ করে না, তার উপরও লা'নত বর্ষিত হয়।”[6]
হযরত ইবনে আব্বাসের (রাঃ) রেওয়ায়েতে রসূলে করীম (সাঃ) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোন স্থানে উপস্থিত থাকে, সত্য বলা থেকে বিরত থাকা তার জন্যে অনুচিত। কেননা, মৃত্যু নির্ধারিত সময়ের পূর্বে হবে না এবং যে রিযিক তার তকদীরে আছে, তা থেকে সে বঞ্চিত হবে না। ˹এমতাবস্থায় সত্য কথা বলতে ভয় কিসের?˺[7]
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে প্রশ্ন করল, ইয়া রসূলাল্লাহ্, এমন জনপদও ধ্বংস হয় কি, যেখানে সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ থাকে?
তিনি বললেন, হাঁ।
প্রশ্নকারী এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “কেননা, সৎকর্মপরায়ণরা অলসতা করে এং আল্লাহ তা'আলার নাফরমানীতে চুপ থাকে।”[8]
জাবের ইবনে আবদুল্লাহর রেওয়ায়েতে নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেন, “আল্লাহ তা'আলা জনৈক ফেরেশতাকে আদেশ করলেন, অমুক শহরকে তার বাসিন্দাদের উপর উল্টিয়ে দাও। ফেরেশতা আরজ করল, ইয়া রব, সেই শহরে আপনার অমুক বান্দা আছে, যে এক মুহূর্তও আপনার নাফরমানী করেনি। আল্লাহ বললেন, তার উপর এবং সকল অধিবাসীর উপর শহরটিকে উল্টিয়ে দাও। কেননা, বস্তিবাসীদের নাফরমানী দেখে এক মুহূর্তের জন্যেও তার মুখমণ্ডল ক্রোধে রক্তিম হয়নি।”[9]
হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, একবার রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এরশাদ করলেন, “এক জনপদের অধিবাসীদেরকে আযাব দেয়া হল। তাদের মধ্যে আঠার হাজার লোক এমন ছিল, যাদের আমল পয়গম্বরগণের আমলের মত ছিল।”
লোকেরা আরজ করল, ইয়া রসূলাল্লাহ্, এটা কিরূপে হল?
তিনি বললেন, “তারা আল্লাহ্ তা'আলার জন্যে ক্রুদ্ধ হত না এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করত না।”
আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ্ (রাঃ) বলেন, আমি আরজ করলাম, “ইয়া রসূলাল্লাহ্, শহীদগণের মধ্যে আল্লাহ তা'আলার কাছে অধিক মহৎ কে?”
তিনি বললেন, “সে ব্যক্তি, যে কোন যালেম শাসনকর্তার সামনে দাঁড়িয়ে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে এবং এ কারণে নিহত হয়। যদি যালেম শাসনকর্তা তাকে হত্যা না করে, তবে সে যতদিন জীবিত থাকবে তার আমলনামায় গোনাহ্ লেখা হবে না।”[10]
একটি হাসান হাদিসে আছে, “সর্বোত্তম জিহাদ হচ্ছে অত্যাচারী শাসকের সম্মুখে সত্য কথা বলা।”[11] আরেক হাদিসে আছে, “যখন তুমি আমার উম্মতকে দেখবে যে তারা যালিমকে ‘যালিম’ বলতে ভয় পেতে শুরু করেছেন, তখন তুমি তাদের কাছ থেকে বিদায় নেবে।”[12] অর্থাৎ হিজরত করে চলে যাবে।
হাসান আল বসরি হতে বর্ণিত, নবীজি ﷺ বলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম শহীদ সেই ব্যক্তি যে যালিম শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। আর এই ‘অপরাধের’ কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়। জান্নাতে এই শহীদের মর্যাদা হামজা আর জাফরের মাঝে হবে।”
এ সম্পর্কে কিছু আছার
হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেন, তোমরা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ কর। নতুবা আল্লাহ তা'আলা তোমাদের উপর কোন অত্যাচারী শাসনকর্তা চাপিয়ে দেবেন। সে তোমাদের বড়দের সম্মান করবে না এবং ছোটদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করবে না। তোমাদের সৎলোকেরা তাকে বদদোয়া দিলে সেই বদদোয়া কবুল হবে না। তোমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে সাহায্য পাবে না। ক্ষমা প্রার্থনা করলে তোমাদেরকে ক্ষমা করা হবে না।
নাহি আনিল মুনকার শুধুমাত্র প্রকাশ্য মুনকারের বেলাতেই করা হয়। এর পেছনে হেকমত বর্ননা করে বেলাল ইবনে সা'দ বলেন, “নাফরমানী যখন গোপনে করা হয়, তখন তা কেবল কর্তারই ক্ষতি করে। কিন্তু যখন প্রকাশ্যে করা হয় এবং কেউ তা নিষেধও করে না, তখন পুরো সমাজের সকলেরই ক্ষতি করে।”
ফুদ্বাইল ইবন ইয়ায’কে কেউ জিজ্ঞেস করল, আপনি সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজে নিষেধ করেন না কেন? তিনি বললেন, “কিছু লোক আদেশ ও নিষেধ করে কাফের হয়ে গেছে। কারণ, এর উপর আমল করার কারণে যেই অত্যাচার তাদের উপরে এসেছে তার উপর তারা সবর করতে পারেনি।”
একই প্রশ্ন সুফিয়ান আস সাওরিকেও করা হয়েছিল। তিনি বললেন, “সমুদ্র যখন ফেটে যায় তখন তাকে কে রোধ করতে পারে?” অর্থাৎ, সমাজে মুনকার এতোই বেশী ছেয়ে গেছে যে সেটা আর রোধ করার মতো সক্ষমতা তার নেই।
সহল ইবনে আবদুল্লাহ তুশতারি (রহঃ) বলেন, কেউ যদি অন্যকে আদেশ/নিষেধ করার ক্ষমতা না রাখে তবে ব্যক্তিজীবনে আল্লাহ তা’আলার আদেশ-নিষেধ মেনে চললে এবং অন্যের মন্দ কাজকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করলে তার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট হবে।
বর্নিত আছে যে, আবদুল্লাহ ইবন উমার (রাঃ) শাসকদের আমলাদের কাছে যেয়ে তাদের সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজে নিষেধ করতেন। কিছুদিন পর তিনি তাদের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিলে লোকেরা তার কারণ জিজ্ঞেস করলো। তিনি বললেন, “আমার ভয় হয় যে তাদের আদেশ-নিষেধ করতে করতে একসময় তারা দেখবে যে আমার নিজেরই কথা আর কাজের মধ্যে মিল নেই। আবার তাদের কাছে যেয়ে চুপ থাকলে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার বর্জনের ফলে আমার পাপ হবে এই ভয়ও করি। ˹তাই আমি আর সেখানে যাই না।˺”
বোঝা গেলো, কেউ যদি কোথাও এই দায়িত্ব পালন করতে নিজেকে অক্ষম মনে করে তবে সেই স্থানে না যাওয়াটাই উচিত। তবে শক্তি ও ক্ষমতা থাকলে তার জন্যে এই দায়িত্ব পালন ওয়াজিব।
আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকারের ফিকহ
আমরা তো সবাই বুঝতে পারলাম সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ করা আমাদের মুসলিমদের ইসলাম আর ঈমানের জন্য কতোটা জরুরি। এই আয়াত আর হাদিসগুলো পড়ে প্রচন্ড মটিভেটেড হয়ে যখন তখন যেখানে সেখানে যাকে তাকে আদেশ নিষেধ করা শুরু করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমল করার আগে প্রয়োজন ইলম, জ্ঞান। আমলটা কীভাবে করবো সেটা জানা ছাড়া সেই আমল করতে গেলে ভুল ছাড়া আর কিছু হবার আশা করাটা বোকামি।
সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ সম্পর্কিত ফিকহ জানতে হলে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে; কে, কাকে, কি, কখন, কীভাবে। অর্থাৎ,
1. আদেশ/নিষেধ কে করবে?
2. কীভাবে এই আদেশ বা নিষেধ করা হবে?
3. কাকে করবে?
4. কখন করতে হবে? আর
5. কি বিষয় নিয়ে আদেশ বা নিষেধ করা যাবে?
ইমাম গাযালি ‘আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’-এর কন্সেপ্টকে সংক্ষেপে নামকরণ করেছেন “হিসবা” হিসেবে। সেই হিসেবে যে এই কর্ম করে তাকে বলা হয় ‘মুহতাসিব’, যাকে আদেশ নিষেধ করা হয় সে হচ্ছে ‘মুহতাসাব আলাইহি’, আদেশ-নিষেধ সম্পর্কিত বিষয়টি হলো ‘মুহতাসিব ফিহী’, আর স্বয়ং আদেশ বা নিষেধটিকে বলা হয় ‘ইহতিসাব’।
[চলবে…]
[1] আবু দাউদ, ৪৩৩৮; সুনানে তিরমিযী, ২১৬৮
[2] বুখারি, ৫৮১; মুসলিম ৮২৬
[3] মুসলিম, ৪৯
[4] ইবনে আদি
[5] ইবনে আবি দুনিয়া
[6] তাবরানি, বায়হাকি
[7] বায়হাকি
[8] আল বাজ্জার, তাবরানি
[9] তাবরানি, বায়হাকি
[10] আল বাজ্জার
[11] তিরমিযী, ২১৭৪
[12] মুসনাদে আহমদ, ৬৫২১
তৃতীয় পর্ব এখানেঃ https://sahilridwan.substack.com/p/e05
দ্বিতীয় পর্ব এখানেঃ https://sahilridwan.substack.com/p/ae4