শারহু আকিদা নাসাফিয়া গ্রন্থের লেখক আশাআরি-মাতুরিদি মুতাকাল্লিম ইমাম সা‘দুদ্দীন আল-তাফতাযানী (মৃঃ ৭৯২ হিঃ) তার অপর বিখ্যাত গ্রন্থ শরহে মাকাসিদ-এ একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন—
فإن قيل: إذا كان الدين الحق نفي الحيز والجهة فما بال الكتب السماوية والأحاديث النبوية مشعرة في مواضع لا تحصى بثبوت ذلك، من غير أن يقع في موضع واحد تصريح بنفي ذلك؟ أجيب بأنه لما كان التنزيه عن الجهة مما تقصر عنه عقول العامة، حتى تكاد تجزم بنفي ما ليس في الجهة، كان الأنسب في خطاباتهم والأقرب إلى إصلاحهم والأليق بدعوتهم إلى الحق ما يكون ظاهراً في التشبيه وكون الصانع في أشرف الجهات مع تنبيهات دقيقة على التنزيه المطلق عما هو من سمة الحدوث.
যদি বলা হয়: বিশুদ্ধ আকিদা যদি “আল্লাহর স্থান ও দিক থেকে মুক্ত” হয় তবে কেন আসমানি কিতাবসমূহ ও নববী হাদিসসমূহের অসংখ্য স্থানে—স্পষ্টভাবে একবারও তা নাকচ করা ছাড়াই—এর বিপরীত বক্তব্য পাওয়া যায়?
উত্তরে বলা যায়: এর কারণ হলো, “দিকবোধ থেকে মুক্তিকরণ” এমন এক বিষয় যা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে। সাধারণ মানুষ নিশ্চিতভাবে মনে করে, যে সত্তা কোনো নির্দিষ্ট দিকে নেই, সে আদৌ অস্তিত্বশীল নয়।
অতএব, তাদের সাথে কথা বলার সবচেয়ে উপযুক্ত পন্থা, তাদের সংশোধনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর ভাষা এবং তাদের হকের দিকে ডাকার সর্বোত্তম কৌশল হলো এমন ভাষা ব্যবহার করা, যা দেখলে বাহ্যিকভাবে তাশবিহ মনে হয় এবং যা আল্লাহকে সর্বোচ্চ সম্মানজনক স্থানে (উলু’) হিসেবে উপস্থাপন করে; একইসাথে সূক্ষ্মভাবে তাঁর পূর্ণতর পবিত্রতা ও সৃষ্টির গুণ থেকে মুক্ত হবারও (তানযীহ) ইঙ্গিত দেয়।"
তাফতাযানীর বক্তব্যের সরল ব্যাখ্যা
ইমাম তাফতাযানীর মতে সঠিক আকিদাহ হলো, আল্লাহ স্থান, দিক ও কাল থেকে মুক্ত। তবুও কুরআন ও হাদিসে (এমনকি পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহেও) তাঁর সাপেক্ষে এমন সব শব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে যা বাহ্যিকভাবে তাশবিহ নির্দেশ করে; যেমন “রহমান আরশের উপর উঠেছেন”, “আমি আদমকে নিজের দু’হাত দিয়ে সৃষ্টি করেছি” ইত্যাদি। এসব শব্দাবলী আল্লাহর ক্ষেত্রে তাশবিহ অর্থাৎ সৃষ্টির মতো কোন এক ধরনের ধারণা (নাউযুবিল্লাহ) সৃষ্টি করে।
ইমাম তাফতাযানি বলেন, সাধারণ মানুষের ব্যাপার হলো, তাদের জ্ঞানবুদ্ধি এমন স্তরে আছে যে তারা স্থান ও দিকহীন কোন সত্তার অস্তিত্ব চিন্তা করতে পারে না। বরং তারা এমন ধারণাকে অস্তিত্বহীন মনে করে থাকে। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষকে আল্লাহ স্থান, কাল, দিক-হীন হিসেবে পরিচয় দিলে তারা আল্লাহর অস্তিত্বকেই সন্দেহ করা শুরু করে দেবে।
এই সমস্যা কাটানোর জন্য আল্লাহ তা'আলা এমন ভাষায় কথা বলেছেন যা বাহ্যিকভাবে স্থান বা আকৃতি বোঝায়। এর ফলে সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারে। তবে এসব বক্তব্যের মাঝেও সূক্ষ্মভাবে আল্লাহর পবিত্রতা, তাঁর অনন্যত্ব ও সৃষ্টির গুণাবলি থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত থাকার ইঙ্গিতও থাকে—যেমন “লাইসাকা মিসলিহী শাই” (আল্লাহ কোনকিছুর মতোই নন)।
তাফতাযানির বক্তব্যের প্রভাব ও তাৎপর্য
১. কুরআনের তাশবিহমূলক শব্দগুলো একটি শিক্ষণ কৌশল (pedagogical device) বিনা কিছু নয়: অর্থাৎ কুরআন সাধারণ মানুষের বোধ-বুদ্ধির সাথে মিল রেখে এমন ভাষা ব্যবহার করেছে যা স্থান বা আকৃতি বোঝাতে পারে। মূলত এর লক্ষ্য হল মানুষের অন্তরে ঈমান আনা ও তাদের শিক্ষিত করা।
২। আক্ষরিক অর্থই চূড়ান্ত উদ্দেশ্য নয়: কুরআনের আল্লাহর দিক বা অবস্থান বোঝানো আয়াতগুলো প্রকৃত সত্য নয়। বরং সাধারণ মানুষের সীমিত মানসিক উপলব্ধিকে বিবেচনায় রেখেই বলা।
৩। জ্ঞানগত শ্রেণিবিন্যাসের ধারণা (epistemological elitism):
এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিচার-বুদ্ধি ও অতি শিক্ষিত এলিট মানুষদের জ্ঞানের তফাত স্পষ্ট করা হয়। সাধারণ মানুষের জ্ঞান ও বোধ নীম্নতর স্তরের দেখে তাদের জন্য সামান্য কিছু তাশবিহ ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু শিক্ষিত এলিট শ্রেণী এমন তাশবিহ থেকে মুক্ত, তারাই আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেন।
৪। তাফওয়ীদ ও তা’উইল হলো এর প্রতিক্রিয়া: কুরআন ও হাদিসের এরকম “তাশবিহ”মূলক শব্দের প্রতিক্রিয়ায় এলিট শ্রেণীর আলেমগন তাফউইদ (শব্দের জ্ঞান পূরোপুরি আল্লাহর উপর ন্যস্ত করেন) অথবা তা’উইল (রুপক অর্থে ব্যখ্যা করেন) করেন, যেন যেকোনোভাবে স্রষ্টাকে সৃষ্টি থেকে পৃথক করে আল্লাহকে তাশবিহ মুক্ত করা যায়।
ইবনে তায়মিয়ার পাল্টা যুক্তি
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নানা কারণে সমস্যাযুক্ত মনে করতেন। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ পাল্টা বক্তব্যগুলো হলো:
১. এর ফলে কুরআনকে বিভ্রান্তিকর মনে হয়:
যদি বলা হয়, সাধারণ মানুষের বোঝার সুবিধার্থে কুরআন এমন ভাষা ব্যবহার করে যা অসত্য, তাহলে কুরআনের স্পষ্টতা ও সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নাউযুবিল্লাহ। অথচ কুরআন দাবী করে যে একে সহযবোধ্য করে নাযিল করা হয়েছে।
২. আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকার করা হয়:
বাহ্যিক অর্থ অস্বীকার করলে আল্লাহর গুণাবলিকেই অস্বীকার করা হয়। অথচ সাহাবাগণ এবং সালাফে সালেহীন কখনো এমন করেননি।
৩. ওহির প্রকৃত ভারসাম্য বিনষ্ট হয়:
কুরআন আল্লাহর গুণাবলি স্বীকার করে এবং একইসাথে তাঁর পবিত্রতা ও অনন্যত্ব বজায় রাখে। এটি তানযিহ ও ইসবাত-এর ভারসাম্য। কোনো রকম সাদৃশ্য আরোপ না করেই বাহ্যিক অর্থ বজায় রেখে (ইসবাতুল মা’না ওয়া তাফউইদুল কাইফিয়্যাহ) এই ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব।
সংক্ষেপে বলা যায়
তাফতাযানীর মতে কুরআনের anthropomorphic বা তাশবিহমূলক ভাষা হল সাধারণ মানুষের মানসিক উপযোগিতার জন্য।
ইবনে তাইমিয়ার মতে, এমন বক্তব্য কুরআনের সততা, সহজবোধ্যতা ও স্পষ্টতাকে অস্বীকার করে। ফলে তা দুই-স্তরবিশিষ্ট সত্য তৈরি করে (mass vs elite)।
এই বিতর্কের মূল প্রশ্ন: "আল্লাহ কি সাধারণ পাঠককে একটি এমন কথা বলছেন যা তিনি চান না সে সত্য হিসেবে গ্রহণ করুক?"
সম্মানিত পাঠক, এই প্রশ্নের উত্তর আপনি নিজেকেই দিন।
وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ قِيلًا
"আল্লাহর চাইতে কথা বলার ক্ষেত্রে কে বেশি সত্যবাদী?"
প্রশ্নটা ফান্ডামেন্টাল এবং এর বিশ্লেষণ এক হাজার বছরেও ইসলামিক সমাজ পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারে নাই । ইবন সিনা এবং আল গাজালির এই বিতর্কে ইসলামিক সভ্যতা এখনও ঘুড়ছে এবং কোন আগপথ পায় নাই ।
এইটা সত্তি যে ইবন তাহমিয়া যখন তার বিশ্লেষণ করেন এবং তার সামাজিক এবং ধার্মিক দুর্নীতির(বিদ্দাহ) অভিযোগ করেন, তখন ইসলামিক সভ্যতা মঙ্গলদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় এবং তার শ্যির্ক এবং দুর্নীতির অভিযোগের সাথে সাধারণ মানুষ একমত হয়ে যায় সহজে ।তারা তও ইসলামিক সমাজের পতন চোখের সামনেই দেখে এবং এর কারণ তাদের খুজতে হয় । ইবন তাহমিয়ার অভিযোগ এবং তার প্রবাভ এই প্রেক্ষিতে পরিষ্কার ভাবে বুঝা যায় । তার কথা আল গাজালির তুলনায় সহজ - আল গাজালির কালেমা এবং সুফি ফ্রেমিং ভুঝা অনেক কঠিন । সালাফিরা হয়তো তাই ইবন তাহমিয়াকে অনুসরণ করে এবং আল গাজালিকে সুবিধামত টানে ।
এই মুহূর্ত ইসলামিক সমাজর অবস্থা ইবন তাহমিয়ার সময়ের মতই করুণ এবং তাই হয়তো তার ডিসকোর্স এতোই প্রচলিত । সমসা যতই করুন ততই সহজ উত্তর মানুষ খুজবে ।