আমরা বক্তা ও বক্তব্যের মাঝে পার্থক্য করতে জানিনা। এই পার্থক্য করতে পারাটা ম্যাচ্যুরিটির পরিচায়ক। কারণ বক্তা যখন বক্তব্য দেয় বা লেখে, ধরা যায় ভেবেচিন্তেই করে। সেখানে ভুলের সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু বক্তা নিজে একজন মানুষ। তার ভুল হবেই, একটি দুটি না, অগণিত ভুল হবে। আল্লাহ্র রাসুল ﷺ বাদে কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। একমাত্র তিনিই পারফেক্ট আইডল হতে পারেন যার কথা আর কর্ম দুটোকেই একটা অপরটার সাথে মিলিয়ে আমরা একত্রে গ্রহণ করতে পারি। অতএব, অন্য কোন মানুষের কর্ম দিয়ে তার লেখা/বক্তব্য কিংবা vice versa বিচার করাটা সঠিক কাজ নয়।
ধরুন আপনি কোন একজন লেখকের লেখা পড়লেন। অনেকগুলো লেখা পড়লেন। সেই লেখার ধাঁচ, যুক্তি, সত্যতা, সঠিকটা নিয়ে আপনি পুরোপুরি কনভিন্সড। এসব পড়ে আপনার মনে স্বাভাবিকভেবি লেখকের প্রতি দুর্বলতা সৃষ্টি হবে, তাকে উত্তম কোন মানুষ হিসেবে কল্পনা করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হয়তো একটু ভিন্ন। একসময় জানতে পারলেন, সেই লেখকের জীবনে কিছু কিছু ভুল আছে, বিচ্যুতি আছে, বাড়াবাড়ি আছে। এসব দেখে আপনার কষ্ট পাওয়াটা একদম স্বাভাবিক। যেন প্রিয়জনের কাছে ছ্যাকা খাওয়ার মতো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, লেখকের নিজস্ব ভুলের কারণে সেই লেখাগুলো কি ভুল হয়ে গেছে? তার যেই যুক্তিগুলোর উপর আপনি সম্পুর্ন কনভিন্সড, তার বাস্তবতা দেখার পর কি সেই যুক্তিগুলো ঠুনকো হয়ে গেছে?
আমাদের ইসলামি তুরাসেই বহু আলেম-উলামা, সুলতান-খলিফা, সূফী-মাশায়েখ গিয়েছেন যাদের দ্বীনের প্রতি প্রচণ্ড খেদমত থাকার পরও নিজ জীবনে কিছু কিছু ভুল ছিল। নবী বাদে যেকোনো ইনসান থেকে এর চাইতে বেশী আশা করাটাই বোকামি।
লজিক্যালি দেখলে লেখার যুক্তির উপর এর কোন প্রভাব পড়ার কথা না। তবে ইমোশনালি দেখলে পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। আমরা শিক্ষিত মুসলিম হিসেবে আমাদের এপ্রোচ কি হওয়া উচিত? জ্ঞানতাড়িত নাকি আবেগতাড়িত?
বিশুদ্ধ তাওহীদের দাওয়াহ বিরোধী কারা? তাওহীদ চিনলে যাদের কবর ও মাজার কেন্দ্রীক ব্যাবসা বন্ধ হয়ে যাবে তারা। যারা নিজের খাহেশাত অনুযায়ী বিদআত ও কুফুরি রসম-রেওয়াজ আর চালাতে পারবে না তারা। আল্লাহ্র হুকুম বিরোধী আইন যাদের হাতে, যাদের ক্ষমতার মসনদে টান পড়বে, তারাই তাওহীদবাদিদের বিরোধী।
এই বিরোধীরা বক্তা ও বক্তব্যের মাঝে সূক্ষ্ম পার্থক্য, জ্ঞান আর আবেগের এই সম্পর্কে সম্পর্কে জানে। তাই যখন কুরআন ও সুন্নাহর দলিলে কুপোকাত হয়ে যায়, তখন তারা অ্যাড হোমিনেম অ্যাটাক করে, ক্যারেক্টার এসাসিনেশন করে। কারণ এই পদ্ধতি সহজ, এর মাধ্যমে সহজেই জনগনের অভিমতকে প্রভাবিত করা যায়।
একজন মানুষ যতো ভালো কথাই বলুক, তার জীবনের ভুলগুলোকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করলে জনগনকে সহজেই প্রতারিত করা যায়, তার থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া যায়। খুবই পুরনো ট্রিক এটি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে উচ্চারিত আল্লাহ্র কালাম কুরআনের ব্যাপারে তারা কিছুই বলতে পারেনি। কোন যুক্তিই ছিল না মক্কার মুশরিকদের। তাই তারা নবীজি (সঃ)-র ক্যারেক্টার এসাসিনেশন করা শুরু করে দিল। তাকে জাদুকর, কবি, পাগল ইত্যাদি গালিগালাজ করলো।
মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাবের দাওয়াহ কার্যক্রমে কিছু বাড়াবাড়ি, কিছু অযাচিত সহিংসতা সংঘটিত হয়েছিল। এটা ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু তার মৌলিক দাওয়াহ ছিল বিশুদ্ধ, তাতে কোন খাদ ছিল না। শত্রুরা সেটাকে খণ্ডন করতে না পেরে সেই মাঠে সেই দাওয়াহ প্রয়োগের ভুলগুলো উপস্থাপন করে জনগনের অপিনিয়ন প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব-এর জীবন সম্পর্কে আমি জেনেছি অনেক পরে। আমার প্রয়োজন পড়েনি। আমি তার লেখাগুলো পড়েছিলাম, তার কিতাব-রিসালাহগুলো পড়েছিলাম। ভালোবেসেছিলাম। কনভিন্সড হয়েছিলাম। এখনো কনভিন্সড আছি। ইসলামের মূল থিম (তাওহীদ) সম্পর্কে তিনি যেভাবে সংক্ষেপে সহজে বর্ননা করেছেন তাতে আমি কনভিন্সড। এখন তার জীবনে করা পলিটিক্যাল কিংবা দ্বীনি দিক থেকে ভুলগুলো দেখলে কষ্ট লাগলেও সেই লেখাগুলোকে সেগুলো মিথ্যা করে দেয় না।
শাইখ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব তৎকালীন প্রেক্ষাপতে তাওহীদ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কিছু স্থানে বাড়াবাড়ি করেছেন। তার অনুসারীরা আরও বেশী করেছিল। তবে দিনশেষে বাস্তবতা হলো এই যে, তার এই তাজদিদি দাওয়াত না আসলে আজকের মুসলিম বিশ্বে মাজার আর কবর জনিত শিরক হয়তো আরও অনেক অনেক গুণ বেশী দেখতে পাওয়া যেতো।
শাইখ মুহাম্মদ হাসান আদ-দিদো বলেন, “মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাবের দাওয়াহ তাঁর পরবর্তী সমস্ত ইসলামি দাওয়াহকে প্রভাবিত করেছে। দুনিয়াতে এমন কোন ইসলামি দল-মত-মাসলাক-দাওয়াহ নেই যা তাঁর দাওয়াতে সালাফিয়্যাহ দ্বারা কমবেশী প্রভাবিত নয়। কিন্তু অনেকেই এই দাওয়াহকে কন্টেক্সটের বাইরে নিয়ে যায়। সালাফিয়্যাত এমন দাওয়াহ যেটা সারাক্ষণ বিবর্তিত হচ্ছে। শুরুতে এটা সশস্ত্র দাওয়াহ ছিল। পরবর্তীতে রাষ্ট্র সেটার অনুসরণ করেছে, ফলে মানুষ তাদের অস্ত্র রাষ্ট্রের হাটে তুলে দিয়েছে। অর্থাৎ সামরিক সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর অর্পিত হলো। আক্রমণকারীরা এই দাওয়াহকে রক্তপিপাসু বলে উপস্থাপন করতে চায়। কিন্তু তারা বুঝে না যে সেসময়ে প্রয়োজনের খাতিরেই এই দাওয়াহ সশস্ত্র ছিল।”
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও মুহাক্কিক, ইলমী মহলে মুতাদিল ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্বীকৃত শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ হালাবি (মৃ.১৪১৭ হিজরী) বলেন, “ইমামুদ দাওয়াহ শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল ওয়াহাব নজদি (মৃ.১২০৬ হিজরী) দাওয়াতের ময়দানের ইমাম। তিনি সর্বসম্মতিক্রমে একজন দাওয়াতের ইমাম ও আল্লাহর দিকে আহবানকারী ছিলেন। তিনি তার অবস্থা, নিবন্ধ, আমল ও কলম দ্বারা দাওয়াতের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। আমি সর্বদাই তার বড়ত্ব, মহত্ত্ব, পান্ডিত্য এবং দাওয়াতি কাজে লেগে থাকার ভূমিকার কথা স্বীকার করি। এটি এমন দাওয়াহ যা কুসংস্কার ও কুপ্রথা থেকে আকিদার শোধনে, আল্লাহর কালিমা বুলন্দিতে উৎকৃষ্টতর ফলাফলও দিয়েছে। ইলম প্রচার, উলামাদের প্রাচুর্যতা ও ইলমী ইনস্টিউটের প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে তার কীর্তিসমূহের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যা তাঁর উৎকৃষ্ট দাওয়াতি কর্মপন্থার একটি প্রভাব। ইসলাম ও মুসলমানদের সমর্থনে প্রত্যেক শহরে তাঁর অবদান স্পষ্ট।”1
প্রত্যেক মুয়াহহিদ (তাওহীদপন্থি) এটা জানে যে আল্লাহ যদি শাইখ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (রহঃ)-কে উম্মতের তাজদিদ করার লক্ষ্যে না আনতেন, তার দাওয়াহ যদি এভাবে পুরো বিশ্বে দাবানলের ন্যায় ছড়িয়ে না পড়তো, তবে আজ হয়তো মৃত বুজুর্গদের কাছে দুয়া, তাদের কাছে রিজিক চাওয়াটাই হতো “মেইনস্ট্রিম সুন্নি ইসলাম” বলে সবাই মনে করতো। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
কালিমাতুন ফি কাশফি আবাতিল ওয়া ইফতিরাআহ (পৃ.২৪)




Jazakallah