আমার যতটুকু পড়াশোনা, সে অনুযায়ী দাড়ির ব্যাপারে বুঝ হলো:
দাড়ি রাখা ওয়াজিব। অকারণে একদম শেভ করা হারামের কাছাকাছি পর্যায়ের।1
নুন্যতম ততটুকুতে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে যা দেখলে মনে হয় সে মুসলিম2 অথবা মুখে দাড়ি রেখেছে।
সুন্নাহ হলো মোটামুটি এক মুষ্টির3 কমবেশীর মধ্যে থাকা।
এর চাইতে বড় করলেও ভালো, তবে অবশ্যই সুন্দর, পরিষ্কার, প্রেজেন্টেবল, ভদ্রলোকের মতো হতে হবে। অপরিচ্ছন্ন, উচু নীচু, আগোছালো, unkempt লাগে এরকম রাখা যাবে না।4
আবার অতিরিক্ত বড় করে পেট/নাভী ছাড়িয়ে যায় এরকম রাখা মাকরুহের পর্যায়ে চলে যাবে। এসবের কারণে দেখতে কটু লাগে, আর তা কম বুদ্ধিরও পরিচায়ক।5
আল্লাহু 'আলাম।
এখানে একটা বিষয় ক্লিয়ার করা দরকার একাডেমিক সততার খাতিরে।
চার মাযহাবের মধ্যে শাফেয়ী মাযহাবের মত এদিক দিয়ে সবচাইতে উদার। যদিও ইমাম শাফেয়ী খোদ মনে করতেন দাড়ি অকারণে শেইভ করা হারাম, তবুও এই মাযহাবের কেন্দ্রীয় মত হচ্ছে, কোন ধরণের ওজর ব্যাতিতই দাড়ি শেইভ করা শুধুমাত্র মাকরুহ, হারাম নয়। তবে নববি সুন্নাহ মেনে দাড়ি রাখা মুস্তাহাব।
এটা শাফেয়ী মাযহাবের প্রধানতম দুই ইমাম (নববি ও আবুল কাসিম আল-রাফি) সহ ইমাম গাযালির মত।
আবার বর্তমান সময়ের অন্যতম হানাফি আলেম শায়খ ফারায রাব্বানি বলেন6,
হানাফি মাযহাব অনুযায়ী দাড়ি রাখা সুন্নাতে আদাতের অংশ, সুন্নাতে হেদায়াত নয়7।
আদব, শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে নবিজির আদেশ মুস্তাহাব বা উৎসাহ নির্দেশ করে, ওয়াজিব বা বাধ্যতা নয়।
হানাফি মাযহাব অনুযায়ী এক মুষ্টি পরিমাণ দাড়ি রাখা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা/হুদা নয়, বরং সুন্নাতে আদত। সুতরাং এটা ওয়াজিব নয়, বরং মুস্তাহাব।
ভারতীয় উপমহাদেশের হানাফিরা দাড়ির ক্ষেত্রে যে মত পোষণ করে, সেটা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের হানাফি আলেমদের বোঝাপড়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং হানাফি মাযহাবের উসুল অনুযায়ী এই মত প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য।8
দাড়ির মাসআলা একটি ইখতেলাফি মাসআলা। শাফেয়ী মাযহাবে দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক নয়।
চার মাযহাবের মধ্যকার যে কোন শুদ্ধ মত কেউ গ্রহণ করলে, তার নিন্দা-সমালোচনা করা যাবে না। এটা মূলধারার ইসলামের প্রতিষ্ঠিত নীতিবিরোধী।
কেউ চাইলে তার নিজ মতের দিকে মানুষকে আহ্বান করতে পারে। পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু ভিন্নমত পালনকারীর ব্যাপারে খারাপ ধারণা রাখার সুযোগ কারো নাই।9
দাড়ি কতোটুকু কাটবো?
মালিকি মাযহাবের বিখ্যাত গ্রন্থ ইবনে আবি যায়দ আল কায়রোয়ানির লেখা "রিসালা"। এর বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন ইমাম নাফরাওয়ি "আল ফাওয়াকিহুদ দাওয়ানি" নামে। তিনি বলেন,
(قَالَ مَالِكٌ (وَلَا بَأْسَ بِالْأَخْذِ مِنْ طُولِهَا إذَا طَالَتْ) طُولًا (كَثِيرًا) بِحَيْثُ خَرَجَتْ عَنْ الْمُعْتَادِ لِغَالِبِ النَّاسِ فَيُقَصُّ الزَّائِدُ لِأَنَّ بَقَاءَهُ يَقْبُحُ بِهِ الْمَنْظَرُ، وَحُكْمُ الْأَخْذِ النَّدْبُ فَلَا بَأْسَ هُنَا لِمَا هُوَ خَيْرٌ مِنْ غَيْرِهِ وَالْمَعْرُوفُ لَا حَدَّ لِلْمَأْخُوذِ، وَيَنْبَغِي الِاقْتِصَارُ عَلَى مَا تَحْسُنُ بِهِ الْهَيْئَةُ
ইমাম মালিক বলেন, "দাড়ি যদি বেশি লম্বা হয়ে যায় তবে তা কেটে ফেলতে সমস্যা নেই।" বেশি লম্বা বলতে অধিকাংশ মানুষ যতটুকু লম্বা রেখে অভ্যস্থ তার চেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতে হবে কেননা এটা রেখে দিলে দেখতে খারাপ দেখায়। দাড়ি কাটার হুকুম হল এটা মানদুব (উত্তম)। সুতরাং এক্ষেত্রে যেটা অন্যটার চেয়ে ভালো সেটা করতে সমস্যা নেই। জ্ঞাতব্য যে, কতটুকু কাটতে হবে এই ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই। তবে আকৃতিতে যতটুকু সুন্দর ততটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ।
[এখানে বিভিন্ন উক্তিগুলো বিভিন্ন মানুষের অনুবাদ থেকে কপি করা। তাই আলাদা করে তাদের ক্রেডিট দিলাম না।]
হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘দুররে মুখতারে’ (২য় খ. ৪৫৯ পৃ.) বলা হয়েছে: পুরুষের জন্য দাড়ি কর্তন করা হারাম। নিহায়া গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, দাড়ি এক মুষ্টির বেশি হলে তা কেটে ফেলা ওয়াজিব। কিন্তু এর চাইতে বেশি কর্তন করা যেমনটি পশ্চিমা দেশের লোকেরা এবং খোঁজা পুরুষেরা করে তা কেউ বৈধ বলেন নি। আর দাড়ি সম্পূর্ণটাই কেটে চেঁছে ফেলা হিন্দুস্থানের ইয়াহূদী ও কাফের–মুশরিকদের কাজ।”
ইমাম আবু হানিফার প্রধান ছাত্র এবং হানাফী মাযহাবের রূপকারদের একজন ইমাম আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ যিনি কিতাবুল আসারে বলেন, “ইউসুফ তার পিতা আবু ইউসুফ থেকে, তিনি আবু হানীফা থেকে, তিনি হাম্মাদ থেকে, তিনি ইব্রাহিম নাখই থেকে বর্ণনা করেন, "দাড়ি ছোট করায় কোন সমস্যা নেই যতক্ষণ মুশরিকদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করা হচ্ছে না।" সূত্র: ইমাম আবু ইউসুফ রচিত কিতাবুল আসার, পৃষ্ঠা ২৩৫, রেওয়ায়াত নং ১০৪২।
ইবনে আবিদিন এবং ইবনে হুমাম বলছেন, এক মুষ্টির নিচে যে দাড়িটা কাটা হয় এর এর ব্যাপারে কোন রকমের অনুমতি কোন ফকিহ দেয়নি।
মাথার কেশের ময়লা ও উকুন ধোয়া, চিরুনি করা ও তেল দেয়ার মাধ্যমে পরিষ্কার করা মোস্তাহাব, যাতে কেশের এলোমেলো অবস্থা ও চেহারার আতংকভাব দূর হয়। রসূলুল্লাহ (সাঃ) মাঝে মাঝে চুলে তেল দিতেন ও চিরুনি করতেন। তিনি মাঝে মাঝে তেল দেয়ার আদেশ করেছেন। তিনি বলেছেন: যার চুল আছে, তার উচিত চুলের পরিচর্যা করা। অর্থাৎ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এক ব্যক্তি আগমন করল। তার দাড়ি ছিল বিক্ষিপ্ত এলোমেলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: চুল পরিপাটি করার জন্যে তোমার কাছে কি তেল ছিল না? এরপর বললেন: তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ শয়তানের রূপ ধরে আগমন করে। - ইহইয়া উলুমিদ্দীন
“It is recommended to let the beard grow without removing any of it… ‘so long as it’s lengthiness is not unpleasant’. It is impermissible to shave it but not sinful to remove whatever exceeds a fist length.” Source: Kashf al-Mukhadarat
ইবনুল জাওযি নির্বোধ ও উন্মাদদের পরিচিতি ও বিবরণ নিয়ে একটি বই লিখেছেন। নাম রেখেছেন "আখবারুল হামকা ওয়াল মুগাফফালিন" (নির্বোধ ও উদ্ভ্রান্তদের খবরাখবর)। বইতে তিনি নির্বোধ চেনার একটি লক্ষ্মণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার দীর্ঘ ও লম্বা দাড়ি। ইবনুল জাওযি লেখেন, وقال الأحنف بن قيس: إذا رأيت الرجل عظيم الهامة طويل اللحية فاحكم عليه بالرقاعة ولو كان أمية بن عبد شمس. — আহনাফ বিন কায়েস বলেন, "যদি কোন লোককে দেখ তার বিরাট মাথা ও লম্বা দাড়ি, তবে তাকে নির্বোধ বলে বিবেচনা কর, যদিও সে উমাইয়া বিন আব্দে শামস হয়।"
وقال عبد الملك بن مروان: من طالت لحيته فهو كوسجٌ في عقله. — উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান বলেন, "যার দাড়ি লম্বা হয়, তার আকল পাতলা হয়।"
দাড়ি নিয়ে আবু তালেব আল মাক্কি তার "কুতুল কুলুব" বইতে লেখেন, وكان إبراهيم النخعي ومثله من السلف يقول: عجبت لرجل عاقل طويل اللحية كيف لا يأخذ من لحيته فيجعلها بين لحيتين فإن التوسط في كل شيء حسن — ইব্রাহিম নাখই ও তার মত সালাফরা বলতেন, "বুদ্ধিমান লোকের কীভাবে লম্বা দাড়ি থাকতে পারে এই নিয়ে আমি আশ্চর্য হই। সে কেন তার দাড়ি কেটে দুই থুতনির মাঝে রাখে না? নিশ্চয়ই প্রত্যেক বিষয়ে মধ্যমপন্থাই সুন্দর।"
একইভাবে হানাফি মাযহাবের বিখ্যাত বই "আল বাহরুর রায়েক" এ ইবনে নুজাইম অতিদীর্ঘ দাড়িকে নির্বোধ চেনার একটি পদ্ধতি হিসেবে উল্লেখ করেছেনঃ ويستدل على صفته من حيث الصورة بطول اللحية — "চেহারা-সুরতের দিক থেকে (আহমক) চেনার একটি পদ্ধতি হল তার দীর্ঘ দাড়ি।"
ইমাম মালেক বলেন, আমি কোন এক কিতাবে পড়েছি, “দাড়ি যেন তোমাকে ধোঁকা না দেয় কারণ তা পাঁঠারও থাকে।”
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহঃ) সুন্নতকে দুভাগে ব্যাখ্যা করেছেন; সুন্নাতুল আদাত (অভ্যাসগত সুন্নাহ) ও সুন্নাতুল হুদা (হেদায়েতের বা ইবাদতগত সুন্নাহ)। শুধুমাত্র সুন্নাতুল আদাত পালন করাতে কোন সোয়াব নেই। তবে রাসুলের (সঃ) মুহাব্বতে তাঁর আচরণ, চলন-ফেরন, অভ্যাস ইত্যাদি হুবুহু কপি করার কারণে সেই মুহাব্বতের কারণে সোয়াব হবে। যেমন নবীজি (সঃ) সফরে কোন নির্দিষ্ট স্থানে প্রাকৃতিক কর্ম সেরেছেন। এটাকে হুবুহু কপি করেছিলেন ইবন উমার (রাঃ), অথচ অন্য কোন সাহাবি করেননি। রাসুলুল্লাহ (সঃ) তরকারি থেকে লাউ বেছে বেছে খেয়েছিলেন দেখতে পেয়ে একজন সাহাবীর প্রিয় খাদ্য লাউ হয়ে গেলো। এগুলো মুহাব্বত। মুহাব্বতের সোয়াব আছে, তবে শুধুমাত্র এগুলো পালন করাতে আলাদা সোয়াব নেই। আর সুন্নাতুল হুদা হলো সুন্নতে মুয়াক্কাদা, যা নবীজি (সঃ) ও সাহাবীগন ইবাদত হিসেবেই নিয়মিত করেছেন।
এটা নিয়ে আরেকটু আলোচনা এখানে পাবেনঃ www.facebook.com/story.php?story_fbid=2312620702254383&id=100005194279329&mibextid=xfxF2i&rdid=4gai7SwuQsOzXroA
এটা নিয়ে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার টপিকে এই ব্লগের আর্টিকেল সিরিজটি দেখা যেতে পারে।