কোন কথা বা কাজকে কুফর বলা আর কাউকে কাফির বলা একই জিনিস না। কাউকে কাফির বলা মানে তার উপর মুরতাদের হুকুম পালন হবার সম্ভাবনা চলে আসা। যাকে তাকে তাকফীর যেমন দুনিয়াতে শৃঙ্খলা নষ্ট তথা ফেতনা-ফ্যাসাদ তৈরি করতে পারে তেমনি তাকফীরকারীর আখিরাতও বরবাদ করে দিতে পারে।
দুঃখজনকভাবে এক শ্রেণীর অতি আবেগী ভাইয়েরা যাকে তাকে ওপেনলি মুরতাদ বলে ওঠেন। তারা খেয়াল করেন না, তারা নিজেরা যেসব আলেম ও সিনিয়র ভাইদের ফলো করেন তারা নিজেরা এই তাকফীর করে না। কারণ তারা তাকফীরের প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে সচেতন। এটাকেই বলে সূর্যের চাইতে বালির গরম বেশী।
যাই হোক, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার তাকফির নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়লাম। নিচে সেটা আপলোড করে দিচ্ছি। সেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীদের তাকফীর তিনি করেছেন কি না, করলেও কতটুকু করেছেন সেটা নিয়ে আলাপ আছে।
মূল কথা হলো, ইবন তাইমিয়া বারবার সতর্ক করে বলেন যে তাকফির (কাউকে কাফির ঘোষণা করা) একটি শরয়ী হুকুম (ইসলামী আইনি বিধান), এবং সবাই এই ঘোষণা দেওয়ার যোগ্য নয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, তাকফির তখনই করা যাবে যখন এর শর্তগুলো পূরণ হবে এবং বাধাগুলো দূর হবে। তিনি বলেন, তাকফির করার অধিকার শুধু আল্লাহর। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ, যারা সালাফের অনুসরণ করে, তারা তাদের বিরোধী হলেই কাফির বলেন দেন না।
তিনি আরও বলেন, আহলুস সুন্নাহ কেবল এই কারণে তাকফির করেন না যে, কেউ তাদের কাফির বলেছে। অর্থাৎ তারা প্রতিশোধ হিসেবে তাকফির করেন না।
শিয়াদের তাকফীর
ইন্টারেস্টিংলি তিনি সব শিয়াদের তাকফির করেননি। তিনি শিয়াদের মধ্যে তিনটি ভাগ করেছেনঃ কাফির, চরম বিদআতি, হালকা বিদআতি।
১। কাফির - ইসমাইলি, নুসাইরি, কারামিতা, বাতিনিয়্যা, দ্রুয, তায়্যিবি। এরাই হলো রাফেযী। এদের আকিদা চরম ভয়ানক। এমনকি এদের আম পাবলিক ইহুদি-খৃষ্টানদের আম পাবলিক থেকেও নিকৃষ্ট।
২। চরম বিদআতী - ইমামিয়া বা ইসনা আশআরিয়া। এদের কেউ কেউ কাফির। কিন্তু ওভারঅল গ্রুপ হিসেবে কাফির নয়।
৩। সাধারন বিদাআতী - যায়েদী শিয়া। এদের আকিদা ও ফিকহ আহুলুস সুন্নাহর নিকটবর্তী, তবে পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত নয়।
শাইখ মিযান হারুন এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন,
“শিয়াদের সবাই কাফের নয়। তাদের মাঝে বাতেনী যথা ইসমাঈলী, নুসাইরী, কারামেতী, আগাখানী, বাহাই, নূরবখশী ইত্যাদি সম্প্রদায় নিকৃষ্ট পর্যায়ের কাফের। তাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ বারা (সম্পর্কহীনতা) বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। তাদের সঙ্গে ঐক্য গড়া, তাদের মৃত্যুতে দুআ করা অবৈধ। রাফেজী-ইমামী তথা জাফরী ও খুমাইনীপন্থী সম্প্রদায়ও নানাবিধ কুফরে নিমজ্জিত বিশেষত শাসক ও পুরোহিত শ্রেণী। তাদের মাঝে যারা কুরআন বিকৃতিতে বিশ্বাসী, কয়েকজন সাহাবা ব্যতীত বাকি সবাইকে গালি-গালাজ ও অভিসম্পাতকারী, গাইরুল্লাহর ইবাদতকারী তারা কাফের। তাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ বারা বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। যারা এমন কুফরীতে লিপ্ত নয় তারা ফাসেক। তাদের সঙ্গে ওয়ালা-বারার সমন্বয় করতে হবে। রাফেজীদের বাইরে যায়দীসহ একাধিক শিয়া সম্প্রদায় আহলুস সুন্নাহর কাছাকাছি। তাদের সঙ্গেও ওয়ালা-বারার সমন্বয় যথা তাদের ভ্রান্তির সমালোচনা করা, আবার মারা গেলে দুআ করা, উম্মাহ কেন্দ্রিক ইস্যুতে প্রয়োজনে সম্মিলিতভাবে কাজ করা বৈধ।… বাস্তবতা হলো, শিয়ারা বাতেনী-রাফেজী, কাফের-ফাসেক নির্বিশেষে কোনো যুগে মুসলমানদের বন্ধু ও দীনী ভাই হয়নি। কোনো যুগে তারা ইসলাম ও মুসলমানদের প্রকৃত অর্থে কাজে লাগেনি। এই পারসিক জাতি ইসলামের ছায়ায় এলেও কোনো কালে পারসিক জাত্যাভিমান, পারসিক ঐতিহ্য ও প্রথা ছাড়তে পারেনি। অন্যান্য ভূখণ্ডের মুসলমানদের মতো ইসলামের কাছে নিজেকে সর্বদিক থেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দিতে পারেনি।… যখনই মুসলমানরা তাদের ওপর ভরসা করেছে, তারা পেছন দিক থেকে ছুরি মেরেছে। তারা খিলাফতকে দুর্বল ও ধ্বংস করেছে। হিন্দস্তানের মুসলমানদের গৌরব মোঘল সাম্রাজ্য ধ্বংসের পেছনেও অন্যতম দায়ী এই সম্প্রদায়। ইসলামের নামে মুসলমানদের মাঝে গড়ে ওঠা অধিকাংশ শিরক ও বিদআত, অপবিশ্বাস ও অপসংস্কৃতির উৎস এরা। এরা মুসলিম উম্মাহর গলার কাঁটা। মুসলমানদের দুর্ভোগ ও দুর্গতির হোতা।… আফসোস হয়, আমাদের দেশের কিছু সরলমনা, ইসলামপ্রিয় মানুষ বাতেনী ও রাফেজী শিয়াদের মাঝেও ইসলামী বিপ্লবের পাথেয় ও বিপ্লবী মুসলমানের আদর্শ খুঁজে পান। সময়ে সময়ে ইসলাম ও উদারতার নামে ‘শিয়া-সুন্নী’ ভ্রাতৃত্বের শ্লোগান দেন। অথচ এসব রাফেজীর বড়ো অংশ প্রকাশ্য কুফরে লিপ্ত। আমি তাদের নিয়ত নিয়ে সন্দেহ করি না। কিন্তু তাদের অজ্ঞানতার প্রতি সমবেদনা জানাই। দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী কিংবা তারও বেশি সময়েও যারা রাফেজীদের চিনতে সক্ষম হননি, গণহারে যারা তাদের প্রতি দুর্বলতা ও সমবেদনা প্রকাশ করেন, তাদের সঙ্গে ঐক্য গড়ার স্বপ্ন দেখেন, তাদের কথিত বিপ্লবে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন, তারা এই দেশে কখনো স্থায়ী ও সত্যিকার পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হবেন এমন উচ্চাশা কীকরে রাখি? যে ঐক্য ও বিপ্লবে ইসলামের মৌলিক আকীদা প্রতিফলিত হবে না, কালিমার দাবি অটুট থাকবে না, সেই ঐক্য সাময়িকভাবে গড়ে উঠলেও কখনোই কল্যাণের হতে পারে না।”
সুফিদের তাকফীর
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া তৎকালীন সুফি তরিকার বড় অংশকে তাকফীর করেছিলেন। যে সব অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের কাফের ঘোষণা করেছিলেন সেগুলো হলো—
১. ওয়াহদাতুল ওজুদ (সত্তার একত্ববাদ)
২. ওয়াহদাতুল আদইয়ান (সমস্ত ধর্মের ঐক্য)
৩. সাকতুত তাকলিফ (শরিয়তের রহিত হওয়া)
৪. নবুওতের দাবি করা
৫. বেলায়েতকে কে নবুয়তের চাইতে উচ্চস্থানে রাখা
৬. আল্লাহর সিফাত অস্বীকার করা
শাইখুল ইসলাম কঠোরভাবে ইবন আরাবি (ফুসুসুল হিকাম) ও তার অনুসারীদের (সদরুদ্দিন কুনাভি, তিলমিসানি, ইবন সাব'ঈন, শুশতারি, ইবন ফারিদ)। তার মতে সদরুদ্দিন কুনাভির বিশ্বাসে ইবন আরাবির চাইতেও বেশি কুফরি ছিল। তিনি বলেন, ইবন আরাবির চাইতে কুনাভির দ্বীনি ইলম কম ছিল। তবে কুফরির ব্যাপারে তার ইবন আরাবির চাইতেও বেশি দক্ষতা ছিল।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ওয়াহদাতুল ওজুদ মতবাদের প্রবল বিরোধী ছিলেন। তিনি এই মতবাদের বিরুদ্ধে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যার নাম হাকীকাত মাযহাবুল ইত্তিহাদিয়্যিন ("সংযুক্তিবাদীদের বাস্তব মতবাদ")। এটা মাজমু' আল-রসাইল ওয়াল-মাসাইল-এর ৪-৫ খন্ডে পাবেন।
তিনি সুফিদের ব্যাপারে অভিযোগ করেন যে তারা "লাইসা ইল্লাল্লাহ" (অর্থাৎ, "আল্লাহ ছাড়া কিছুই নেই") মতবাদ প্রচার করেছিল। তাদের মতে ফেরাউন যখন বললো, "আমি তোমাদের সর্বোচ্চ প্রভু", তখন ফেরাউন মিথ্যা বলেনি। কারণ ফিরআউন নাকি ছিল এক মহান আরিফ (আধ্যাত্মিক জ্ঞানী)। তাদের বিশ্বাস, ফেরাউন মুমিন অবস্থায় মারা গিয়েছিল ও সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ছিল।
ইবন তাইমিয়া সুফিদের ভয়ানক আকিদার ব্যাপারে লেখেন:
তারা নিজেদের ওয়াহদাতুল ওজুদের (সত্তার একত্ববাদ) অনুসারী বলে দাবি করে। তারা দাবি করে যে তারা সত্য উপলব্ধি (তাহকীক) ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান (‘ইরফান) অর্জন করেছে। তারা মনে করে স্রষ্টা ও সৃষ্টির অস্তিত্ব অভিন্ন। অতএব, সৃষ্টির যেকোনো বৈশিষ্ট্য—হোক তা ভাল বা মন্দ, প্রশংসনীয় বা নিন্দনীয়—আসলে সৃষ্টিকর্তারই বৈশিষ্ট্য। তাদের বিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সৃষ্টির থেকে পৃথক বা স্বতন্ত্র নয়। বরং সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি একই সত্তা এবং তাঁর বাইরে অন্য কিছু অস্তিত্বশীল নয়।
তাদের একটি প্রসিদ্ধ উক্তি হলো: "আল্লাহ ছাড়া কিছুই নেই"। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা দাবি করে যে মূর্তিপূজকরা (মুশরিকরা) প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করেনি। কারণ তাদের মতে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। এই কারণে তারা কুরআনের "আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করবে" (কুরআন ১৭:২৩) আয়াতটির ব্যাখ্যা দেয় "তোমার প্রতিপালক নির্ধারণ করেছেন যে, কেবল তিনিই উপাসনার যোগ্য" হিসেবে। তাদের মতে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ নেই, ফলে যে কোনো উপাসনা—তা মূর্তির উদ্দেশ্যে হোক বা অন্য কিছুর—বাস্তবে আল্লাহরই উপাসনা।
এই মতবাদ অনুসারে ফুসুস আল-হিকাম-এর লেখক ইবন আরাবি দাবি করেন যে, মূসার (আ.) যুগে যারা স্বর্ণের বাছুরের ইবাদত করেছিল তারা প্রকৃতপক্ষে ভুল করেনি। তিনি আরও বলেন, মূসা (আ.) হারুনকে বাছুরের ইবাদতের জন্য তিরস্কার করেননি। বরং হারুন (আ.) এই ‘উচ্চতর সত্য’ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই তিনি তিরস্কার করেছিলেন। তাদের মতে, মূসা (আ.) জানতেন যে বাছুরপূজকরা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই উপাসনা করছিল। কারণ আল্লাহ ইতোমধ্যে নির্ধারণ করে দিয়েছেন যে, কেবল তিনিই উপাসিত হবেন। অন্যদিকে, যেহেতু আল্লাহর আদেশ ব্যতীত কিছুই ঘটে না, তাই হারুনের (আঃ) প্রতি মুসার (আঃ) তিরস্কার অযৌক্তিক ছিল। কারণ বিষয়টি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ছিল।
তাদের মতে, সত্যিকারের আরিফ তো সেই ব্যক্তি যে সমস্ত কিছুর মধ্যে আল্লাহকেই দেখতে পায়। বরং সে তো আল্লাহকেই সব কিছুর মূল সত্তা হিসেবে দেখে। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা ফিরাউনকে এক মহান আরিফ (জ্ঞানী) ও মুহাক্কিক (সত্য উপলব্ধিকারী) বলে গণ্য করে। তাদের মতে, ফিরাউন তার রুবুবিয়্যাতের দাবিতে সঠিক ছিল। কারণ ফিরাউন ছিল তার যুগের শাসনক্ষমতা ও সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী (সাহিবুল-ওয়াক্ত)। যেহেতু সে প্রাকৃতিক আইন (আন-নামুস আল-উরফি) অনুযায়ী শাসন করেছিল, তাই তার দেবত্বের দাবি যথার্থ ছিল।
~ ইবন তাইমিয়া, মজমু’ আল-ফাতাওয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১২৪
দার্শনিকদের তাকফীর
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া সবচাইতে কঠিন তাকফির করেছিলেন দার্শনিকদের (ফাইলাসুফ)। তিনি দার্শনিকদের ইহুদি, খৃষ্টান, এমনকি আরব মুশরিকদের থেকেও নিকৃষ্ট মনে করতেন। কি কারনে এমন কঠিন তাকফির? কারণ দার্শনিকদের বিশ্বাসগুলো ছিল নিম্নরুপ—
1. বিশ্বজগতকে কাদিম মনে করা
2. নবুয়ত অস্বীকার
3. আল্লাহর প্রত্যেক বস্তুর নির্দিষ্ট (জুযিয়্যাত) জ্ঞান অস্বীকার
4. আল্লাহর সিফাত অস্বীকার
5. দেহের পুনরুত্থান অস্বীকার
6. ওহি ও ফেরেশতা জিবরাইলকে কেবল কল্পনা মনে করা
7. নুসুসের অতিরিক্ত রুপক ব্যাখ্যা দেয়া
তিনি দার্শনিকদের বিরোধীতায়, তাদের চরম বিভ্রান্তিকর আকিদা ও অন্যান্য কারণে তাদের নকল-দার্শনিক (মুতাফালাসিফা) হিসেবে নামকরন করেছিলেন।
তবে শাইখ আকরাম নদভিকে আমি বলতে শুনেছি, ইবনে তাইমিয়া নাকি বলেছেন, দুনিয়াতে নবিগন না থাকলে দার্শনিকরাই নাকি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হতো। ব্যাপারটা খটকা লাগলো। তিনি দার্শনিকদের আকিদার ব্যাপারে এরকম মন্তব্য করার পরও তাদের সম্পর্কে এভাবে বলবেন কেন?
যেখানে ইবনে তাইমিয়া (রহ)--
~ দার্শনিকদের রদ্দ করে এত্ত এত্ত বই লিখেছেন,
~ স্পষ্ট ভাষায় তাদের তাকফির করেছেন,
~ তাদের ব্যাপারে বলেছেন যে তারা শুধু এক মত থেকে আরেক মতে লাফাতে থাকে,
~ নিজেরাই একে অন্যের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক দেয়,
~ যাদের মধ্যে দলাদলি বিভেদের অন্ত নেই,
~ যাদের তিনি নামকরন করেছিলেন মুতাফালাসিফা (নকল-দার্শনিক) নামে
ঠিক সেই দার্শনিকরাই নাই মানবজাতির শ্রেষ্ট হতো নবীদের অবর্তমানে?! ব্যাপারটা ঘটকা লাগতে পারে। পরে দেখলাম, আসলে শাইখুল ইসলাম দার্শনিকদের সময়ের বিবেচনায় দুটো দলে ভাগ করেছিলেন, (১) অ্যারিস্টটলের আগের দার্শনিক ও (২) অ্যারিস্টটলের পরের দার্শনিক।
ইবনে তাইমিয়া মূলত অ্যারিস্টটল পরবর্তী দার্শনিকদের বিরোধীতা করতেন। বিশ্বজগতকে কাদিম মনে করার আকিদা অ্যারিস্টটল থেকেই এসেছিলো। পরে সেই বিশ্বাস পরবর্তী দার্শনিকরা আরও আজেবাজে আকিদা মিশ্রিত করে ছড়ানো শুরু করে।
অ্যারিস্টটলের আগের দার্শনিকদের ব্যাপারে তার ধারনা আশ্চর্যজনক! তাদের ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়ার ধারনাগুলো দেখুন--
১। তারা একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল (মুয়াহহিদুন)।
২। তারা বিশ্বাস করতো যে এই বিশ্ব সৃষ্ট।
৩। তারা দেহের পুনরুত্থানে বিশ্বাস করতো।
৪। তারা এই পৃথিবীর বাইরে একটি জান্নাতের অস্তিত্ব স্বীকার করতো।
৫। তারা "সাবিয়ুন হুনাফা" (সৎ সাবিয়ান) দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদের আল্লাহ কুরআনে প্রশংসা করেছেন।
ইবনে তাইমিয়ার মতে, অ্যারিস্টটলের আগের দার্শনিকরা এসব জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভ করেছিল লুকমান, দাউদ ও সুলাইমানসহ অন্যান্য নবীগন থেকে। আলাইহিমুস সালাম।
অর্থাৎ সব নষ্টের মুল এই আরিস্তু, যাকে পরে মুসলিম বিশ্বে দর্শন চর্চাকারীগন সম্মান করে আল-মুয়াল্লিমুল আউয়াল বা প্রথম শিক্ষক হিসেবে নামকরন করে।
জাহমিয়াদের তাকফীর
আমাদের ইসলামি তুরাসে আহলুস সুন্নাহ দ্বারা জাহমিয়াদের তাকফীরের প্রধান কারণ হলো আল্লাহর সিফাত অস্বীকার করা। একই কারনে ইবনে তাইমিয়া ফালাসিফা ও কতক সুফিদের তাকফীর করেছেন।
ইবনে তাইমিয়া বলেন, সালাফ ও ইমামগণ জাহমিয়্যাদের কাফের ঘোষণা করেছেন। কারণ ঈমানের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ উপর বিশ্বাস রাখা আবশ্যক। রাসূল ﷺ আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে তাঁর নাম ও গুণাবলী। তাই রাসূলের উপর ঈমান রাখা মানেই তাঁর বাণীর সত্যতা স্বীকার করা। কিন্তু কিছু মানুষ সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর গুণাবলী অস্বীকার করার মাধ্যমে রাসূল ﷺ-কে অস্বীকার করেছে। আবার কিছু মানুষ রাসুল-কে বিশ্বাস করলেও তাঁর প্রেরিত বার্তাকে অস্বীকার করেছে। জাহমিয়ারা উভয় দলেই পড়ে যায়।
ইবনে তাইমিয়া বলেন, সালাফ ও ইমামগণ জাহমিয়্যাহদের কাফের বলেছেন কারণ তাদের আকিদা تعطيل (তা‘তীল - আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকার করা) এবং إلحاد (ইলহাদ - সত্য বিশ্বাস থেকে বিচ্যুতি) এর দিকে পরিচালিত করে। সালাফগন জাহমিয়্যাদের তাকফির সম্পর্কে এমনভাবে আলোচনা করেছেন যা অন্য বিদআতিদের সম্পর্কে করেননি।
ইবনে তাইমিয়া আরও বলেন যে, আল্লাহর সিফাত অস্বীকার করা কিয়ামতের দিন শারীরিক পুনরুত্থান অস্বীকার করার চেয়েও বড় বিভ্রান্তি। কারণ আল্লাহর গুণাবলীর প্রমাণ রাসূলের ﷺ বাণীতে শরীরী পুনরুত্থানের চাইতেও বেশি সংখ্যকবার ও জোরালোভাবে এসেছে।
সংক্ষেপে ইবনে তাইমিয়ার মতে জাহমিয়্যাহদের তাকফীর করার কারণগুলো হচ্ছে--
১। আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকার করা (تعطيل - তা‘তীল)
২। পরকালে আল্লাহকে দেখার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করা
৩। বিশ্বাস করা যে কুরআন সৃষ্ট (মাখলুক)
৪। আরশের ওপর আল্লাহর ‘উলু ও ইস্তিওয়া অস্বীকার করা।
শাইখুল ইসলামের তাকফীর নীতি
ইবন তাইমিয়া মনে করেন, যেসব বিষয়ের ব্যাপারগুলো স্পষ্ট এবং যেসব বিষয়ের কুফর স্পষ্ট করা প্রয়োজন, সেখানে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে লক্ষ্য না করে তাকফির সাধারণভাবে প্রয়োগ করা উচিত। কাউকে নির্দিষ্টভাবে কাফির বলার আগে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে যে সব শর্ত পূরণ হয়েছে এবং কোনো বাধা নেই। এটা তখনই করা যাবে যখন সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে সকল প্রমাণ অকাট্য হয়।
তিনি বলেন, আম-তাকফির (কোন বিশ্বাস, কর্ম বা গোষ্ঠীকে তাকফীর করা) একটি সতর্কতার মতো—এর মানে এই নয় যে এমন বিশ্বাস করা, কর্ম করা বা সেই গোষ্ঠীর সকল ব্যক্তিকেই উম্মাহ থেকে খারিজ করে দেয়া হবে। যদি কেউ তার ভুল বুঝতে পারে এবং সত্য গ্রহণ করে, তাকে ক্ষমা করা হয়। যদি কেউ তার দায়িত্বে অবহেলা করে, তবে তা পাপ হিসেবে গণ্য হয়, কিন্তু তা কুফর নয়। কোনো বক্তব্যকে কুফর বলা যেতে পারে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে যে ব্যক্তি সেই বক্তব্য দিয়েছে সে আবশ্যিকভাবেই কাফির হয়ে গেছে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন যে খাওয়ারিজ, রাফিদাহ, কাদারিয়্যাহ, জাহমিয়্যাহ এবং অন্যান্যদের মধ্যে তাকফিরের অনেক ঘটনা ঘটে, কারণ তারা তাদের বিরোধীদের কথার প্রকৃত অর্থ ভুল বোঝে।
তাই, ইবন তাইমিয়া মনে করেন যে তাকফিরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং এর জন্য স্পষ্ট নীতি অনুসরণ করা উচিত। তিনি বলেন, সঠিক নিয়ন্ত্রণের অভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক যেমন কবিরা গুনাহ করা ব্যক্তিদের কাফির ঘোষণার বিষয়টি অতীতে এবং বর্তমানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।