দ্বীনকে জানার জন্য আর তাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার জন্য ইসলামের ইতিহাস শেখার বিকল্প নেই। সেই ইতিহাসের মধ্যে পড়ে নবীজি সঃ এর সীরাহ, খুলাফায়ে রাশিদিন সহ সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আজমাইনদের জীবনী, আহলে সুন্নাহ এর ইমামগনের জীবনী এবং বর্তমান কাল পর্যন্ত ইসলামি খিলাফত ব্যবস্থার ইতিবৃত্ত। আজকের যুগে যখন পৃথিবী থেকে খিলাফত পুরোপুরিভাবে উঠে গিয়েছে তাই তাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের জন্য তেরশ বছর খিলাফতের সঠিক ইতিহাস জানা বাধ্যতামূলক। আর কেন সেই খিলাফত বিলুপ্ত হয়ে গেলো সেটা জানতে হলে উসমানী ইতিহাস অধ্যয়নই একমাত্র উপায় (খিলাফত বিলুপ্তের কারণগুলো রিভিউর শেষে আসছে)।
ইতিহাসবিদ ড. সাল্লাবীর মূলনীতি
ইসলামি খিলাফত, বিশেষ করে উসমানি সাম্রাজ্যের ইতিহাস এখন পর্যন্ত যতজন লিখেছে, হাতেগোনা অল্প কয়েকজন ছাড়া মোটামুটি সবাই ওরিয়েন্টালিস্ট অথবা তাদের দ্বারা প্রভাবিত। তাই সেসব বইতে ইসলাম বিদ্বেষসহ খিলাফতে উসমানিয়ার সময়কে কলুষভাবে চিত্রায়িত করেছে। এমনকি অনেক আরব ইতিহাসবিদও তাদের জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজম দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছে। ইসলামি ইতিহাসের প্রতি এই জঘন্য কালিমা লেপনকারীদের মধ্যে অগ্রগন্য হলো ইহুদি ও জায়নবাদী ফ্রিমেসন গোষ্ঠী। তাছাড়া খিলাফতের সময় এই বিদ্বেষ ইউরোপময় ছড়াতো তৎকালীন পোপ, বিশপ, পাদ্রি ও রাজারা। তারা এই অবস্থান নিয়েছিল উসমানিদের বিশাল বিশাল বিজয়ের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে।
ড. আলি সাল্লাবী এসব বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন যে উসমানি সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে এই বই পুরোপুরিভাবে ওরিয়েন্টালিস্টদের প্রভাবমুক্ত। তাই তিনি এই অংশের শেষদিকে বলেন,
“যখন আমরা আধুনিক ইতিহাস লিখতে যাবো, তখন আমাদের জন্য আবশ্যক হচ্ছে ইতিহাসের এই নিকৃষ্ট বিকৃতির পেছনে ফ্রিমেসনারিদের ভূমিকা এবং পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে দেওয়া। এমনভাবে এই ইতিহাস বিকৃতির পিছনে দায়ী ইহুদি, খ্রিষ্টান, এবং স্বাধীনতার নামধারী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রচারকদের গোমর ফাঁস করে দেওয়া।”
বইয়ের অধ্যায় ও পরিচ্ছেদের বিভক্তি
লেখক বইটিকে প্রধান ছয়টি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। সেগুলো হলো-
প্রথম অধ্যায়ঃ তুর্কিদের শেকড় এবং পরিচয়
এখানে দেখানো হয়েছে যে উসমানিয় খিলাফতের মুলত তুর্কিয় জনগোষ্ঠী আর তারা হলো সেলজুক বংশদ্ভুত। সেলজুকদের আদি বংশ ট্রান্স-অক্সানিয়া হতে নিজেদের চাইতে শক্তিশালি গোত্রদের থেকে পালিয়ে তাদের থেকে পশ্চিমে চলে আসে। সেখানে আব্বাসিয় খিলাফতের ছত্রছায়ায় ধীরে ধীরে সেলজুক সাম্রাজ্য বিস্তার করে। এখানে আরো আলোচনা হয়েছে সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তুঘরিল বেক, তার ভাতিজা পরববর্তী সেলজুক সুলতান আলপ আরসালান ও তার সন্তান মালিক শাহ এর জীবনী। সাথে যোগ করা হয়েছে বিশ্বখ্যাত নিজামুল মুলক আত তুসির জীবনী। তিনি ছিলেন আলপ আরসালান ও মালিক শাহের সময়কার উজির এবং সেসময় সুলতান ব্যাতিত সেলজুক সাম্রাজ্যের সবচাইতে ক্ষমতাধর ব্যাক্তি।
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এবং বিজয়সমূহ
এখানে লেখক উসমানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান, তার সন্তান উরখান, সুলতান প্রথম মুরাদ, বায়েজিদ, মুহাম্মদ ও সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ সহ অন্যান্য সুলতানদের জীবনী আলোচনা করেছেন বিস্তারিতভাবে।
উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের দাদা সুলাইমান কুর্দিস্তান থেকে এনাটোলিয়াতে হিজরত করেন। তার মৃত্যুর পর আরতুগ্রুল গোত্রের নেতা হয়ে রোমের বিরুদ্ধে সেলজুকদের সাথে যুদ্ধ করে গভীর মিত্রতা স্থাপন করেন।
আব্বাসি খিলাফাতের রাজধানি বাগদাদে যেদিন মোঙ্গলীয়রা আক্রমণ করে সেদিন আরতুগ্রুলের ছেলে উসমানের জন্ম হয়। তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর শুরু হয় ২৭ বছর বয়সে কন্সট্যান্টিনোপলের কুরুহজাহ দুর্গ শাসনের মাধ্যমে। জীবনে তিনি ছিলেন ঈমানি জযবায় পরিপুর্ন একজন বীর যোদ্ধা, একান্ত ধৈর্যশীল একনিষ্ঠ মানুষ এবং প্রজ্ঞাবান ও ন্যায়পরায়ণ শাসক।
তৃতীয় অধ্যায়ঃ সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ ও কন্সট্যান্টিনোপল বিজয়
চতুর্থ অধ্যায়ঃ সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ পরবর্তী শক্তিশালি সুলতানগন
পঞ্চম অধ্যায়ঃ উসমানি সাম্রাজ্যের অধঃপতনের সূচনা
ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ উসমানি সাম্রাজ্যের পতন
সংক্ষেপে উসমানি খিলাফত পতনের কারণ
উসমানি খেলাফত পতনের কারণের পেছনে কারণগুলো বহুমুখী; সামাজিক, ধার্মিক, প্রশাসনিক, বহিরাক্রমণ ও ষড়যন্ত্রমূলক। এর কিছু এখানে উল্লেখ করছি-
১। ধার্মিক কারণঃ উসমানিয় খিলাফত তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল কুরআন ও সুন্নাহর ভাষার অবমূল্যায়ন, সঠিক ইসলামের শিক্ষা সংরক্ষণ করতে না পারা, আল-ওয়ালা ওয়াল বারার মতো সঠিক আকিদা থেকে সরে যাওয়ার কারণে। লোকজন ছিটকে পড়েছিল ইবাদতের সঠিক চিন্তা থেকে আর তাদের অন্তরে বসে গিয়েছিল শিরক, বিদআত এবং ইসলামের নানা অপব্যাখ্যা। ইসলামি শরিয়াহ ও সমাজব্যবস্থায় মৌলিক নীতিবিরোধী বিকৃত সুফিবাদের বিস্তার শাসনব্যবস্থা আল্লাহর শরিয়ত থেকে বিজ্জনকভাবে পিছলে পড়েছিল।
এছাড়া মুসলিম সমাজের খুঁটি উলামায়ে কেরাম সালাফদের নীতির বাইরে যেয়ে কিতাবের মুখতাসার তথা সংক্ষিপ্ত ভাষ্য, ব্যাখ্যাগ্রন্থ, হাশিয়া ও তাকরিরমুখী হয়ে পড়েছিল। তারা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহ থেকে উদ্ভুত ইসলামি প্রকৃত চেতনা থেকে দূরে সরে ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। ইজতিহাদ যেন হয়ে গিয়েছিল মুতাকাল্লিদিনদের (গোঁড়া তাকলিদ পন্থিদের) কাছে কুফুরিসম। তারা বনে গিয়েছিল শাসকদের হাতের পুতুল। উচ্চপদ ও মর্যাদা লাভের প্রতিযোগিতায় উন্মত্ত হয়ে আলেমগন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছিল। ফলে সারা উম্মাহ হয়ে পড়লো ক্ষতিগ্রস্ত।
২। সামাজিকঃ খিলফত ধ্বংসের সবচাইতে প্রধান সামাজিক কারণ ছিল সমাজের পশ্চিমা সভ্যতার দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লোকজনের আচার-ব্যাবহারে এমনকি প্রশাসনিক কার্যক্রম কোনকিছুই পশ্চিমা সমাজের অনুকরণমুক্ত ছিল না।
৩। ষড়যন্ত্রমূলকঃ মুসলিম উম্মাহর শত্রুরা দেখেছিল যে মুসলিম সমাজে জাতীয়তাবাদী মতবাদ ধীরে ধীরে পুশ করলে ও এর প্রচারকদের সমর্থনে তাদের পাশে দাড়ালে উম্মাহ দুর্বল হয়ে খিলাফত ভেতর থেকেই ধ্বংস হয়ে যাবে। এছাড়া উসমানি সমাজে চক্রান্ত করে সউদিয়ার সালাফি মতবাদ প্রচারে বাধাদান করে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য নষ্ট করা ছিল কলোনিয়ালদের আরেকটি ঘৃণ্য চক্রান্ত। এই চক্রান্ত উসমানি সাম্রাজ্যকে সালাফি প্রচারকদের প্রাণকেন্দ্র নজদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত করেছিল।
৪। বহিরাক্রমণঃ মিসর ও শামে নেপলিয়ন তথা ফরাসিদের ভয়ানক আক্রমণ হয় ১৭৯৮ সালে। এরপরপরই মিশরে মুহাম্মদ আলি জাতীয়তাবাদী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এর মাধ্যমে সেই সাম্রাজ্য ইসলামদের মৌলিক স্তম্ভ থেকে পিছিয়ে পড়েছিল।
অনুবাদের মান
অনুবাদের মান ভালো তবে কনসিস্টেন্ট(consistent) না। যেমন লেখকের কথা আর প্রথম অধ্যায়ের সাথে ভূমিকার অনুবাদের মানের কোন মিল নেই। ভূমিকার ৯ পৃষ্ঠা ছাড়া বাকি পুরো অংশটুকু আমার কাছে মাখন লেগেছে। কিন্তু ভূমিকাটি বারবার পড়েও বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল।
এখানে একটি বাক্যের কাঠিন্য উল্লেখ করছি- “আরব প্রাচ্যের পুর্ববর্তী কিছু ইতিহাসবিদ উসমানি সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণে অংশীদার হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল পশ্চিমা উপনেশবাদী সাম্রাজ্যগুলোর চক্রান্তের শিকার হয়ে উসমানি সাম্রাজ্য কর্তৃক বেশকিছু স্তরে সালাফিদের প্রচারে বাধা দেওয়া।” (পৃষ্ঠা ২৫)
দ্বীনে ফিরে আসার পর হতে ইসলামি বই সংগ্রহ করে পড়া আমার নেশায় পরিনত হয়েছে। ইসলামি ইতিহাসের বই বলতে রাসুলের সঃ সীরাহ আর খুলাফায়ে রাশেদীনের জীবনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাম। কয়েকমাস আগে উসমানিয় খিলাফত ও মোঙ্গল আক্রমণ নিয়ে বিস্তারিত লেখা এক বই হস্তগত হয়। মোটা সেই বইটি মোটামুটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করেছিলাম। তখন থেকে ইসলামি খিলাফত বিশেষ করে উসমানিয় খিলাফত সম্পর্কে আরো বেশি করে জানার আগ্রহ প্রবলভাবে অনুভুত হতে থাকে।
তাছাড়া শুরুতেই বলেছি যে, বর্তমান সময়ে যখন খিলাফত ফিরিয়ে আনার যে ইচ্ছে আমাদের মনে জাগ্রত হচ্ছে, কি কি কারণে তা নষ্ট হয়েছিল তা না জানতে পারলে সেগুলো দূর না করা অবধি সেটা ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। আর এসবই আমরা পাবো উসমানিয় খিলাফত নিয়ে পড়ালেখা করে। সেই ইতিহাসের বিশুদ্ধ ও সত্য রুপ ড. আলি মুহাম্মদ সাল্লাবী ছাড়া আর কার বইতেই বা পেতে পারি?