এই মূলনীতিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মূলনীতি ঠিকভাবে না বোঝার কারণেই সিফাত নিয়ে সাধারণ জনগনের মাঝে প্রচণ্ড ভুল বোঝাবুঝি, একেবারে ভুল প্রশ্ন উত্থাপন ইত্যাদি হয়ে থাকে। একটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনাটি শুরু করি তাহলে—
আল্লাহ ﷻ কুরআনে বলছেন,
كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ
সবকিছুই ধ্বংসশীল তাঁর চেহারা ব্যতীত।[1]
كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَيَبْقٰى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلٰلِ وَالْإِكْرَامِ
যা কিছুই আছে ˹ভূপৃষ্ঠের˺ ওপর সবই নশ্বর। এবং ˹শুধু˺ বাকি থাকবেন তোমরা রবের চেহারা। মহিমাময় মহানুভব।[2]
আছারীরা (হাম্বলি/সালাফী) যখন এই আয়াতের ভিত্তিতে আল্লাহ্র সাপেক্ষে وَجْه বা চেহারা সাব্যস্ত (ইছবাত) করে তখন মুতাকাল্লীমগণ (আশআরী/মাতুরিদী) প্রশ্ন করেন, “সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে তাঁর চেহারা ব্যতীত? তার মানে কি তাঁর বাকি অংশও ধ্বংস হয়ে যাবে? শুধু চেহারাই বাকি থাকবে?”
নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক! তাদের থট প্রসেসটা চিন্তা করে দেখুন।
প্রথমে তারা ধরেই নিল, আল্লাহ্র ওয়াজহ আছে মানে চেহারা নামক অঙ্গ আছে। অঙ্গ থাকা সৃষ্টির একটি বৈশিষ্ট্য। অতএব যারা আল্লাহ্র চেহারা নামক অঙ্গ আছে বলে সাব্যস্ত করে তারা দেহবাদী মুজাসসিম। চেহারা যেহেতু একটি অঙ্গ, তাই আমরা ওয়াজহ নামক শব্দের অর্থ জানিনা বলে দাবী করবো। তারপর মানুষকে বোঝানোর জন্য এই শব্দের অন্য কোন একটি ব্যাখ্যা দাড় করাবো। এর ফলে আমরা দেহবাদ থেকে মুক্ত থাকতে পারবো।
প্রশ্ন হলো, তাহলে আল্লাহ কেনই বা কুরআনে ওয়াজহ শব্দটি আনলেন? অর্থই যদি না থাকবে তবে তিনি তো চাইলেই الٓمٓ, الٓمٓصٓ, الٓر ইত্যাদির মতো হুরুফে মুকাত্তাআত ব্যবহার করতে পারতেন। অথচ ওয়াজহ, ইয়াদ, আইন ইত্যাদির মতো শব্দগুলো তো হুরুফে মুকাত্তাআতের মতো অর্থহীন অক্ষরের সমষ্টি নয়! বরং এসব হচ্ছে ভ্যালিড আরবি শব্দ, যেগুলো কোন কিছুর সাপেক্ষে বা প্রসঙ্গের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে।
কালামীদের থট প্রসেসের দিকে ফিরে আসি। দেখুন তারা সর্বপ্রথম আল্লাহ্র সাপেক্ষে এসব শব্দকে অঙ্গ হিসেবে কল্পনা করছে। এটাকে বলে তাজসিম। এরপর এই অঙ্গ আল্লাহ্র সাপেক্ষে দূর করার জন্যে শব্দের স্বাভাবিক অর্থকেই নাকচ করে দিচ্ছে। একে বলে তা’তিল। এরপর এই “অর্থহীন” শব্দের মধ্যে তারা নিজস্ব একটি অর্থ ব্যাখ্যাস্বরূপ বসিয়ে দিচ্ছে। একে বলে তা’উইল।
এরকম তারা কেন করছেন? এর উত্তর প্রথমে উল্লেখিত মূলনীতিতে আছে। এই মূলনীতি না বোঝার কারণেই এমন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। সালাফদের কিছু কিছু উদাহরণ তারা টেনে নিয়ে আসে নিজেদের পক্ষে প্রমাণ করার জন্যে যে, “এই দেখো সালাফরা এই সিফাতের তাবিল করে এই অর্থ করেছেন”।
সনদ বিশুদ্ধ থাকলে আমাদের মানতে আপত্তি নেই যে অনেক সালাফই এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে তারা এটা ধরতে পারে না যে তারা আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন, সিফাতের নয়। সালাফ ও আছারীরা আয়াতের তাফসির ও সিফাতের ইছবাত দুটোকে ভিন্ন ভিন্ন জিনিস হিসেবে দেখে।
প্রথমে উল্লেখিত আয়াত দুটো থেকে আছারীরা প্রমাণ পায় যে আল্লাহ্র وَجْه বা চেহারা আছে। এই وَجْه বা চেহারা হলো তাঁর বিশেষণ বা সিফাত। এই সিফাত তাঁর সত্ত্বাগত সিফাত। তাই وَجْه বা চেহারা তাঁর সম্পূর্ণ সত্ত্বার সাথেই সম্পৃক্ত। এই সিফাত তাঁর কোন অঙ্গ বা অংশ নয়। এই সিফাতের সাথে সৃষ্টির وَجْه বা চেহারার কোনই মিল নেই। এই وَجْه বা চেহারা আল্লাহ জাল্লা জালালুহুর শান অনুযায়ী তাঁর সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত। তবে এর ধরণ জানিনা, এই সম্পর্কে চিন্তা করা তো দূর, প্রশ্নও করি না।
এই দুটো আয়াত সহ হাদিসে বর্নিত আল্লাহ্র وَجْه বা চেহারা সম্পর্কিত অন্যান্য বর্ননা থেকে আছারীরা (সালাফি/হাম্বলি) আল্লাহ্র وَجْه সাব্যস্ত করে। এই হলো আল্লাহ্র সিফাত সাব্যস্ত করা ও তাবিল না করার বিষয়টি।
তাহলে আয়াতের তাফসীরের ব্যাপারটি কেমন?
আল্লাহ্র এই وَجْه নামক সিফাতটি যখন কুরআনের একটি আয়াতে পড়ি, তখন প্রসঙ্গ বা কনটেক্সট অনুযায়ী সম্পুর্ন আয়াতের বুঝ বা তাফসির হতে পারে অন্য রকম। কনটেক্সট অনুযায়ী আয়াতের সেই তাফসীর সেই আয়াতের অবস্থিত আল্লাহ্র সিফাতকে নাকচ করে দেয়না। সেই তাফসীরের অর্থটিও সিফাতের অর্থ বদলে (তা’উইল) দেয় না।
প্রথমে উল্লেখিত আয়াত দুটো দেখি। সেখানে একদম শাব্দিক অনুবাদ করা হয়েছে। প্রথম আয়াত كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ টির শাব্দিক অনুবাদ হয় “সবকিছুই ধ্বংসশীল তাঁর চেহারা ব্যতীত”। কিন্তু কনটেক্সট অনুযায়ী আয়াতের তাফসীর বা ব্যাখ্যা হয়ঃ
১। “সবকিছুই ধ্বংসশীল তাঁর সত্ত্বা ব্যতীত”।
২। “সবকিছুই ধ্বংসশীল তাঁর মুলক/রাজত্ব ব্যতীত”।
৩। “সবকিছুই ধ্বংসশীল তাঁর সন্তুষ্টির জন্যে করা ভালো কাজ ব্যতীত”।
এই তিনটি তাফসীরই আরবি ভাষাগতভাবে বিশুদ্ধ। এই তিনটি তাফসীরই সালাফদের থেকে বর্নিত। আর তাই এই তিনটি তাফসীরই আছারীগন (হাম্বলি/সালাফী) মেনে নেয়। তাদের তাফসীরের কিতাবে এই অর্থগুলোই বর্ননা করা আছে। এই তিনটি তাফসীরের একটিও আল্লাহ্র وَجْه সিফাতকে নাকচ করে না।
তাহলে আয়াতের এই ব্যাখ্যার কারণে কি তারা আয়াত হতে প্রাপ্ত আল্লাহ্র সিফাতের ভিন্ন অর্থ সাব্যস্ত করছে? না, করছে না। সিফাতকে তারা সিফাতের স্থানেই রেখেছে। কিন্তু আয়াতের সেই তাফসীরই করেছে যা কনটেক্সট দাবী করছে।
সমস্যা হলো, কালামীরা সালাফদের এই বক্তব্য ও সালাফীদের এই ব্যাখ্যাকে তুলে এনে তাদের তথাকথিত দ্বিচারিতা প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। এটা পুরোই বাচ্চাসুলভ একটি কান্ড।
তাই এতক্ষন আলোচিত মূলনীতির আলোকে কুরআনের বাকি সব আলোচনাগুলো পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সালাফগন সেসব আয়াতের ভিত্তিতে আল্লাহ্র সিফাত সাব্যস্ত করেছেন। আবার একইসাথে কনটেক্সটের ভিত্তিতে সেই আয়াতের তাফসীরও করেছেন। কালামীরা (আশআরী/মাতুরিদী) আয়াতের সেই তাফসীরকে আল্লাহ্র সিফাতের তা’উইল ভেবে ভুল করেছে। এর ফলে তারা সিফাতের তাহরিফ করে ফেলেছে। এটাই সালাফগন প্রচণ্ড শক্তভাবে বিরোধীতা করেছেন।
অনুশীলন
আল্লাহ বলেন,
قَالَ يٰٓإِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَىَّ
হে ইবলিশ! আমি যাকে নিজ দুই হাত দিয়ে সৃষ্টি করেছি তাকে সিজদা করতে তোমাকে কে বাধা দিল?[3]
وَقَالَتِ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ ۚ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَآءُ
ইয়াহুদীগণ বলে, ‘আল্লাহর হাত সংকুচিত।’ তাদের হাত সংকুচিত হোক! এবং তারা যা বলে, তার জন্য তারা অভিশপ্ত হোক! বরং আল্লাহর উভয় হস্তই মুক্ত। যেভাবে ইচ্ছা তিনি দান করে থাকেন।[4]
إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ
নিশ্চয় যারা তোমার বায়আত গ্রহণ করে, তারা তো আল্লাহরই বায়আত গ্রহণ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর।[5]
এই তিনটি আয়াত থেকে আল্লাহ্র সিফাত يَد বা হাত সাব্যস্ত হচ্ছে। কালামীরা তাহরীফ করে থাকে যে আল্লাহ্র يَد বা হাত অর্থ আল্লাহ্র শক্তি। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, যখন আল্লাহ ﷻ তাঁর দুটো হাতের কথা বলেন তখন কি অর্থ হবে “দুটো শক্তি”? আবার আল্লাহ যখন বলেন, “তাঁর হাত তাদের হাতের উপর”, তখন কি এর অর্থ হবে “তাঁর শক্তি তাদের হাতের উপর”?
না। তাদের এই তা’উইল মূলত তাহরিফই প্রমাণ করে। বরং আয়াতগুলো হতে আল্লাহ্র সিফাত يَد বা হাত সাব্যস্ত হয়। একইসাথে এই يَد বা হাত আয়াতের ভেতর কনটেক্সট অনুযায়ী তাফসীর করলে প্রথম আয়াতের ক্ষেতে বাস্তবিকই “হাত”, দ্বিতীয় আয়াতে বাগধারার মাধ্যমে “উদারতা” ও তৃতীয় আয়াতে “সমর্থন” অর্থ প্রকাশ করে।
আয়াতের এই তাফসীরগুলো আল্লাহ্র সিফাতকে নাকচ করে দিচ্ছে না। বরং আয়াতের কনটেক্সট আমাদের তাফসীর দিচ্ছে। আবার আয়াতগুলো থেকে আমরা আল্লাহ্র সিফাত يَد বা হাত-ও পাচ্ছি।
এই সিফাতের প্রতি আমাদের আকিদা বাকি সকল সিফাতের মতোই। আমরা এর অর্থ জানি, ধরণ জানিনা, এই নিয়ে প্রশ্নও করি না। এই সিফাত আল্লাহ্র সত্ত্বাগত সিফাত, যা তাঁর সত্ত্বার সাথেই সম্পৃক্ত। আল্লাহ তা’আলার সিফাত يَد বা হাত তাঁর কোন অঙ্গ বা অংশ নয়। এটির সাথে সৃষ্টির কোনপ্রকার মিল বা সাদৃশ্যতা নেই। আল্লাহ্র সিফাত يَد বা হাত তাঁর শান অনুযায়ী। তাঁর শান যেমন সর্বোচ্চ, যার জ্ঞান ধারণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তেমনি তাঁর সিফাতের শানও সর্বোচ্চ যার ধরণ বা জ্ঞান ধারণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই।
[1] সূরা ক্বাসাস, আয়াত ৮৮
[2] সূরা আর-রাহমান, আয়াত ২৭
[3] সূরা সদ, আয়াত ৭৫
[4] সূরা মাইদাহ, আয়াত ৬৪
[5] সূরা ফাতহ, আয়াত ১০